মাসুম পারভেজ: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় ৩১ আগস্ট দুপুরে হঠাৎ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আগের রাতে এক ছাত্রীকে তাঁর বাসার দারোয়ান মারধর করে—এই অভিযোগ ঘিরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। এক পর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষ বাধে। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় দিকবিদিক ছুটতে থাকেন কয়েক শ শিক্ষার্থী। আতঙ্কে আশপাশে থাকা অনেক রিকশাচালক সরে যান। কিন্তু সবার ভিড়ে একজন থেকে গেলেন—রিকশাচালক মোহাম্মদ রুবেল হোসেন।
ভুল বোঝাবুঝির শিকার থেকে নায়ক:
রুবেল জানান, প্রথমে শিক্ষার্থীরা তাঁকে স্থানীয় গ্রামবাসী ভেবে আক্রমণ করেন। তাঁর অটোরিকশার চাবিও ভেঙে দেওয়া হয়। তবে এতে তিনি ভীত বা নিরুৎসাহিত হননি। বরং আরও দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়ালেন আহত শিক্ষার্থীদের পাশে। তাঁর ভাষায়, “শিক্ষার্থীরা আমার ভাই বা আত্মীয়ের মতো। তাঁদের কারণেই তো আমাদের সংসার চলে। শিক্ষার্থী না থাকলে আমাদের আয়-রোজগার হতো কীভাবে?”
একের পর এক হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া:
আতঙ্কে সবাই ফিরলেও রুবেল করলেন উল্টোটা। নিজের অটোরিকশায় আহতদের উঠিয়ে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতে থাকেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি ৮৩ জন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ভাড়া নেননি কারও কাছ থেকে। তাঁর অটোরিকশার সিটে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে, সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে।
মানবিকতার জন্য ক্ষুধা ভুলে যাওয়া:
সেদিন দুপুরে খাবার খাওয়ারও সময় পাননি রুবেল। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত তিনি কিছুই খাননি। আহতদের সেবা করাই ছিল তাঁর একমাত্র চিন্তা। পরে এক শিক্ষার্থী তাঁকে জোর করে বিস্কুট ও পানি খাওয়ান। সেই শিক্ষার্থী বলেছিলেন, “আপনি কিছু খান, নইলে আহতদের কে নেবে?”
রুবেলের জীবনসংগ্রাম:
রুবেলের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসার পর থেকে ভাড়ায় অটোরিকশা চালাচ্ছেন তিনি। তাঁর সংসারে স্ত্রী, সাড়ে চার বছরের মেয়ে ও তিন বছরের ছেলে। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয়েই চলে তাঁদের সংসার। অটোরিকশাই তাঁর জীবিকা, আবার সেই অটোরিকশাই হয়ে উঠেছিল শতাধিক আহত শিক্ষার্থীর জীবনরক্ষাকারী বাহন।
সম্মাননা পেলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে:
রুবেলের মানবিক ভূমিকা নজর এড়ায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। তবে রুবেলের চোখে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো শিক্ষার্থীদের কৃতজ্ঞতা। তিনি বলেন, “ওই দিন আমি শুধু মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি। এর বাইরে কোনো কিছুই আমার মাথায় আসেনি।”
এক নিঃশব্দ নায়ক:
যেখানে অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তার খোঁজে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সাধারণ রিকশাচালক প্রমাণ করেছেন—মানবিকতা পেশা বা অবস্থান দেখে আসে না। রুবেলের মতো নীরব নায়করা আছেন বলেই সমাজে এখনো আস্থা বেঁচে আছে।