মশিউর রহমান নাদিম, কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: কিশোরগঞ্জ জজ কোর্টে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করেন সাইফুল ইসলাম। কোর্টে চাকুরির প্রভাব খাটিয়ে এলাকার বিভিন্ন শ্রেনির অন্তত ৩৫ জনকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এসব মামলায় কমপক্ষে দেড় ডজন লোককে করতে হয়েছে হাজতবাস। মামলাগুলোর বেশিরভাগের বাদী হয়েছেন সাইফুলের স্ত্রী, বোন ও শ্যালিকা। তার এমন অত্যাচার থেকে বাদ পড়েনি পরিবারের সদস্যরাও। সাইফুলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা সাক্ষ্য দেওয়া লোকজনকেও করা হয়েছে বিভিন্ন মামলার আসামি।
১৯৯৬ সালে ড্রাইভার পদে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন সাইফুল। ২০০০ সালে তার পারিবারিক একটি বিরোধ মেটাতে যান তৎকালীন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন ব্যক্তি। সালিশের সিদ্ধান্ত তার পক্ষে না যাওয়ায় ঐ সময়েই সালিশান ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই বাড়িঘরে হামলার অভিযোগ এনে ঠুকে দেন মামলা। এখান থেকেই মামলাবাজি শুরু হয় সাইফুলের। এরপর সহোদর ভাই সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৯ টি এবং সৎ ভাগ্নে খাইরুল ইসলামের বিরুদ্ধে করেছেন ১০ টি মামলা। এরমধ্যে বেশিরভাগ মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাসও পেয়েছেন তারা। এছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন সাধারণ মানুষকে মামলার হুমকি দিয়ে নিয়মিত হয়রানির অভিযোগ উঠেছে সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
সদর উপজেলার মুসলিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম। তিনি সাইফুল ইসলামের সৎ বোনের ছেলে। তার জায়গা-জমির সকল বৈধ কাগজপত্র থাকার পরেও মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠিয়ে সেটিও সাইফুল ইসলাম দখল করে নিয়েছেন অভিযোগ খাইরুল ইসলামের। তিনি বলেন, তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছেও লিখিত অভিযোগ করেছেন। এলাকাবাসীর উদ্যোগে করা হয়েছে মানববন্ধনও। তারপরেও কোন প্রতিকার পায়নি এই অসহায় পরিবারটি।
সাইফুল ইসলামের সৎ বোন সালেহা বেগম। একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করেন আয়া পদে। এই নারীর অভিযোগ, কোনরকমে একটি মামলা শেষ হতে না হতেই হয়ে যায় আরেকটি মামলা। প্রতিনিয়ত ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়, আইনজীবীর চেম্বারে। বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি ফেরত এবং মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই চান স্বামীহারা সালেহা।
শুধু তারাই নন, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, সৎ ভাতিজা, তিন ভাগিনা, সৎ বোন জামাই, বিয়াই ও প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে করেছেন বেশ কিছু মামলা। সাইফুলের অন্যায়-অত্যাচার আর হয়রানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সালিশ ও তদন্তে সাক্ষ্য দিয়ে আকলিমা আক্তার নামে এক নারী। সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর আকলিমা আক্তার ও তার স্বামী শহীদুল ইসলামকে আদালতে দায়ের করা একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। এই মামলার বাদী সাইফুল ইসলামের ছোট বোন রেহেনা খাতুন।
খাইরুলের মা ছাড়া এই এলাকায় তাদের আর কেউ নেই। এ পর্যন্ত যারাই তার পক্ষে প্রতিবাদ করেছে তাদেরকেই করা হয়েছে মামলার আসামি। এই ভয়ে কেউই কথা বলতে চান না বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল আউয়াল।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে ফেরার পর সাইফুলের কাছে সম্পদের ভাগ দাবি করেন সহোদর ছোট ভাই সিরাজুল ইসলাম। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় মিথ্যা মামলা। বিগত ৫ বছরে তিনি হয়েছেন ৯ টি মামলার আসামি হয়েছেন অভিযোগ সিরাজুল ইসলামের। তিনি বলেন, এসব মামলায় বছরে তিন থেকে চার মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে তাকে। মাসে কমপক্ষে পাঁচবার কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। ৯ টি মামলার মধ্যে ৮ টিতে খালাস পেয়েছেন তিনি। তার স্ত্রীকেও মাদক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ সিরাজুল ইসলামের।
মুসলিমপাড়া এলাকায় বাসিন্দা আব্দুল লতিফ (৭০) বলেন, বিগত ২৫ বছর সাইফুল ইসলাম বিভিন্ন লোককে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই হতে হয় মামলার আসামি। তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র জজ কোর্টের চাকরির প্রভাবে স্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হয়রানি করে যাচ্ছেন সাইফুল ইসলাম। এই গ্রামের সবাই তার বিষয়ে অবগত বলেও জানান আব্দুল লতিফ।
জেলা জজ কোর্টের ড্রাইভার সাইফুল ইসলামের দাবি তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা। তবে তার স্ত্রী বা বোন কখন কার বিরুদ্ধে কয়টা মামলা করেছেন এ বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। বলেন, তিনি কাজের চাপে খুব একটা বাড়িতে যেতে পারেন না। মাঝে মধ্যে গেলেও কিছুক্ষণ থেকেই শহরে চলে আসেন। এই সময়ের মধ্যে কাউকে কিছু করাও সম্ভব নয়।
কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম রতন বলেন, কেউ যদি মিথ্যা মামলা আনায়ন করে তবে তার বিরুদ্ধে ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।