মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ ফজলে রাব্বি: রায়েরবাজারে বর্বর হত্যা, আজও অমর স্মৃতিতে

জাতীয়

ভোরের দূত ডেস্ক: মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দুইদিন পর ১৮ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে অজস্র লা’শের ভিড়ে পাওয়া গিয়েছিলো একটি লা’শ।

.
লা’শটির দুই চোখ উপড়ানো। সমগ্র শরীরে জুড়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাতের চিহ্ন। দু হাত পিছনে গামছা দিয়ে বাঁধা। লুঙ্গিটা উরুর উপরে আটকানো। হৃদপিন্ড আর কলিজাটা ছিঁড়ে ফেলেছে হানাদার ও নিকৃষ্ট আলবদরেরা।
.
লা’শটি ছিলো ছবির এই ভদ্রলোকের। বিশ্বখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট শহীদ অধ্যাপক ডাঃ ফজলে রাব্বি। তাঁর উপর এতোটাই ক্ষোভ ছিলো নরপশুদের!
.
এই সেই ফজলে রাব্বি, সমগ্র পাকিস্তানকে সাত বার আটি দরে বেচলেও যার মেধা ও মস্তিস্কের দাম উঠবে না৷ উনি সেই ফজলে রাব্বি তিনি যিনি হতে পারতেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানী।
.
ঢাকা মেডিকেলের এমবিবিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় সমগ্র পাকিস্তানে ১ম হয়েছিলেন ফজলে রাব্বী।
.
১৯৬২ সালে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানের অধীনে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি নিয়েছিলেন ডাঃ ফজলে রাব্বি। তাও আবার একটি বিষয়ে নয়, বরং দুটিতে। যথাক্রমে ইন্টারনাল মেডিসিন এবং কার্ডিওলজিতে। দেশে ফিরে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে।
.
মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে মেডিসিনের উপর তাঁর বিখ্যাত কেস স্টাডি ‘A case of congenital hyperbilirubinaemia ( DUBIN-JOHNSON SYNDROME) in Pakistan’ প্রকাশিত হয়েছিলে বিশ্বখ্যাত গবেষণা জার্নাল ‘জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন হাইজিন’ এ।
.
মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে তাঁর বিশ্বখ্যাত গবেষণা Spirometry in tropical pulmonary eosinophilia প্রকাশিত হয়েছিলো ব্রিটিশ জার্নাল অফ দা ডিসিস অফ চেস্ট ও ল্যানসেট ম্যাগাজিনে।
.
আর ১৯৭০ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই ডাঃ ফজলে রাব্বি মনোনীত হয়েছিলেন পাকিস্তানের সেরা অধ্যাপক পুরস্কারের জন্য। পাকিস্তানের ইতিহাসে এতো কম সময়ে সেরা অধ্যাপকের পুরস্কার পাননি ফজলে রাব্বি বাদে আর কেউই।
.
কিন্তু তাঁর আত্মায়, মনে মননে ছিলো বাংলার অসহায়র্ত মানুষ। ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলেন তিনি সেই পুরস্কার।
.
মাত্র ৩৯ বছর বয়সী ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কার্ডিওলজিস্ট। আজকের দিনে বসে কল্পনা করলেই গর্বে বুক ফুলে উঠে।
.
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়েই অধ্যাপক ডাঃ ফজলে রাব্বি আহত মানুষদের সেবা দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেলে বসেই। বেশ কয়েকফা নিজের সাধ্যের চেয়ে বেশী ঔষধ আর অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় গোপন রেখে দিয়েছিলেন চিকিৎসাও।
.
তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িটি ব্যবহৃত হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের নানান কাজে। মূলত ঝুঁকি এড়াতে তাঁর গাড়িতে করে তিনি নিজেই ঔষধপত্র পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানায়। তাঁর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আসা যাওয়া ছিলো নিত্য। তাঁর স্ত্রী জাহানারা রাব্বিও পুরোটা সময় ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন।
.
মুক্তিযুদ্ধের ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর ডাঃ ফজলে রাব্বির স্ত্রী জাহানারা রাব্বী একই স্বপ্ন দুবার দেখলেন। স্বপ্নটা এমন একটা সাদা সুতির চাদর গায়ে তিনি তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে জিয়ারত করছেন এমন একটা জায়গায়, যেখানে চারটা কালো থামের মাঝখানে সাদা চাদরে ঘেরা কী যেন।
.
১৫ই ডিসেম্বর সকালে ঘুম থেকে জাহানারা রাব্বি স্বামীকে এই স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। জবাবে ফজলে রাব্বি মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি বোধ হয় আমার কবর দেখেছ’। শুনে ভয় পেলেন জাহানারা রাব্বি।
.
টেলিফোন টেনে পরিচিত অধ্যাপকদের কারো কারো বাড়িতে ফোন করতে বললেন। দেশের কি অবস্থা জানার জন্য। ডাঃ ফজলে রাব্বিও ফোন করলেন। কিন্তু কারো বাড়িতেই সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিলো না। একসঙ্গে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছেনা খানিকটা অবাক হলেন জাহানারা রাব্বি।
.
নাস্তা করে তাঁরা খেয়াল করলেন আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান উড়ছে। কাছেই কোথাও বিমান থেকে বোমা হামলা চালাতেই বিকট শব্দের আওয়াজ। চমকে উঠলেন জাহারারা রাব্বী।
.
সকাল ১০টার দিকে জানা গেল দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠেছে। এমন সময়ে ডাঃ ফজলে রাব্বি তাড়ার গলায় স্ত্রীকে বললেন, ‘পুরান ঢাকায় যেতে হবে একবার। এক অবাঙালি রোগীকে দেখতে যাবো। দেখেই ফিরে আসবো।’
.
শুনেই জাহারানা রাব্বি বললেন, ‘ওখানে যাওয়ার কাজ নেই। দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। ওরাই তো পাকিস্তানীদের সঙ্গ দিচ্ছে।’
.
জবাবে ফজলে রাব্বি হালকা হেসে বললেন, ‘‘ভুলে যেও না, সে মানুষ।’ জাহানারা রাব্বি বললেন, ‘তুমি যে বল আজই আত্মসমর্পণ করবে। তো মিরপুর মোহাম্মদপুরের লোকদের আমরা ক্ষমা করতে পারব?’ গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাঃ ফজলে রাব্বি বললেন, ‘আহা ওরাও তো মানুষ। তাছাড়া ওদের দেশ নেই।’
.
জাহানারা রাব্বি বললেন, কিন্তু এতসবের পর ওদেরকে ক্ষমা আমরা কেমন করে করবো?’ জবাবে ফজলে রাব্বী বললেন, হ্যাঁ ক্ষমাও করবে এবং এবং আমাদের স্বাধীন দেশে থাকতেও দেবে।’
.
সেদিন ডাঃ ফজলে রাব্বি বাসায় ফিরে এসেছিলেন ফের কারফিউ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই। দুপুরের খাবার ছিলো আগের দিনের বাসি তরকারি। কিন্তু ডাঃ ফজলে রাব্বী উল্টো বলেছিলেন, ‘আজকের দিনে এত ভালো খাবার খেলাম।’
.
জাহানারা রাব্বি এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। দেশের এই অবস্থায় এখানে থাকাটা বিপজ্জনক। জাহানারা রাব্বি স্বামীকে বললেন, ‘চলো এখনই চলে যাই।’ ডাঃ ফজলে রাব্বি বলেছিলেন ‘আচ্ছা, দুপুরটা একটু গড়িয়ে নিই। বিকেলের দিকে না হয় বেরোনো যাবে।’
.
কিছুক্ষণ পর বাবুর্চি এসে বললো ‘সাহেব, বাড়ি ঘিরে ফেলেছে ওরা।’ সিদ্ধেশ্বরীর বাসার বাইরে তখন কাদালেপা মাইক্রোবাস ও একটি জীপ দাঁড়িয়ে। মাইক্রোবাসের সামনে বেশ কয়েক জন তরুণ। পাশেই জীপে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য দাঁড়িয়ে। যে আশংকা করছিলেন জাহানারা রাব্বি, ঠিক যেন তাই হলো।
.
খুব হালকা স্বরে ফজলে রাব্বি জাহানারা রাব্বির দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘টিঙ্কুর আম্মা ওরা আমাকে নিতে এসেছে।’ এরপর দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে বলেছিলেন তিনি। যখন মাইক্রোবাসে তিনি উঠলেন তখন সময় ঘড়িতে বিকেল চারটা।
.
১৮ই ডিসেম্বর ডাঃ ফজলে রাব্বির লাশটি পাওয়া গিয়েছিলো রায়েরবাজার বধ্য’ভূমিতে। দুই চোখ উপড়ানো। সমগ্র শরীরে জুড়ে বেয়’নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাতের চিহ্ন। দু হাত পিছনে গামছা দিয়ে বাঁধা। লুঙ্গিটা উরুর উপরে আটকানো। তাঁর হৃদপিন্ড আর কলিজাটা ছিঁড়ে ফেলেছে হানাদার ও নিকৃষ্ট আলবদরেরা।
.
এই সেই ডাঃ ফজলে রাব্বি, যাঁর গোটা হৃদয় জুড়ে ছিলো বাংলাদেশ আর অসহায়র্ত মানুষ। যার হৃদয় জুড়ে ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। হানাদার ও আল বদরের ঘৃণ্য নরপিশা’চেরা সেই হৃদয়কে ছিঁড়ে ফেললেই কি সমগ্র বাংলার মানুষের হৃদয় থেকে কি তাঁকে বিছিন্ন করা যায়?
.
মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের জন্ম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম এই সন্তানকে। বেঁচে থাকলে আজ ৩৯ এর উল্টো হয়ে ৯৩ বছর পূর্ণ হতো অধ্যাপক ফজলে রাব্বীর।
.
বিশ্বাস করি হাজার বছর পরেও ডাঃ ফজলে রাব্বি থাকবেন আমাদের প্রাণে, হৃদয়ের গহীনে। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই কিংবদন্তি শহীদ বুদ্ধিজীবীকে।
সংগৃহীত

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *