শিহাব আল নাছিম
ভোরের দূত ডেস্ক: ১৯৬৯ সালের আগস্টে পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ হন আব্দুল মালেক যিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে এবং সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থার বিপক্ষে সোচ্চার। তার হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি রাজনীতির এক রক্তাক্ত মোড়। মালেককে খুন করা হয়েছিল ভিন্নমতের কারণে, অথচ তখনও সমাজ বুঝত যে, খুন করা “জায়েজ” নয়। তাই শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত নিন্দা জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এরপর কেটে যায় চার দশক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে শহীদ হন শরীফুজ্জামান নোমানি — ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা। তাকে হত্যা করা হয় ছাত্রলীগের হাতে, রাজনৈতিক বিরোধের কারণে। কিন্তু তখনও সমাজ পুরোপুরি সহিংসতাকে বৈধ করেনি। নোমানীর শিবির পরিচয় কারও কাছে হত্যার অনুমতি ছিল না।
এরও দশ বছর পর, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ হন আবরার ফাহাদ। এক তরুণ, এক মেধাবী ছাত্র, যাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা — “শিবির সন্দেহে”। এই হত্যাকাণ্ড কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো দেশকে। রাষ্ট্র বিচার করেছিল দ্রুত, অনেকেই সাজা পেয়েছিল। কিন্তু এই বিচারও যেন শর্তসাপেক্ষ — “আবরার শিবির ছিল না”, তাই তার জন্য সহানুভূতি জেগেছিল। যদি সত্যিই শিবির হতো, তবে? সমাজ কি তখনও এমনভাবে প্রতিবাদ করত?
এটাই আসল প্রশ্ন।
মালেক বা নোমানীর সময় সমাজ হত্যাকে “অন্যায়” বলত, দলীয় পরিচয় নয়; মানবিকতার জায়গা থেকে। কিন্তু আবরারের সময় এসে আমরা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছি, যেখানে মানুষের অধিকার তার পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে। আজ যদি কেউ “অপছন্দের দলে” থাকে, তবে তার ওপর অন্যায় করা জায়েজ। এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ পরিবর্তন।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন জায়গায় এসেছে যেখানে হত্যাকারীরা নয়, বরং নিহতের পরিচয়ই হয়ে গেছে আলোচনার বিষয়। আবরার ফাহাদ ছিলেন এক তরুণ, যে সত্য বলেছিল — কিন্তু সমাজের এক অংশ চায়নি সেই সত্য শুনতে। তাই তাকে নীরব করা হয়েছে।
আজ আমরা সবাই ছাত্রলীগকে দায় দিই; কিন্তু আসলে দায় শুধু তাদের নয়। দায় এই সমাজের, এই মধ্যবিত্ত মানসিকতার, যারা শিখিয়েছে “ভিন্নমত মানে শত্রু”, “ভিন্ন চিন্তা মানে বিপদ”।
আবরারকে হত্যা করেছে সেই চিন্তাধারা, যা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে ভুলে গেছে।
আমরা ভুলে যাই কারও পরিচয় যাই হোক না কেন, তার জীবন অন্য কারও হাতে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।
নোমানি থেকে আবরার: এই পথচলা আমাদের শেখায়, সহিংসতা কোনো দলীয় বিষয় না; এটা এক সামাজিক ব্যাধি।
যেদিন আমরা শিখব মানুষকে তার দল নয়, তার মানবিকতার চোখে দেখতে,
সেদিনই হয়তো আর কোনো আবরার ফাহাদকে মরতে হবে না।