সম্পাদকীয়: বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনা, আশঙ্কা এবং সহিংসতার শঙ্কা থাকে। ভোট যত ঘনিয়ে আসে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস তত প্রকট হয়। এই প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। অনেকেই মনে করেন, সেনাবাহিনী মাঠে নামলেই ভোটকেন্দ্রে শৃঙ্খলা বজায় থাকে, ভোটাররা নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারেন। তবে ইতিহাস দেখিয়েছে, সেনাবাহিনী থাকলেও সংকট সবসময় কাটে না; কখনও কখনও নতুন বিতর্কও তৈরি হয়।
১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচন ছিল সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণে শান্তিপূর্ণ। জনগণ আস্থা ফিরে পেয়েছিল, এবং ফলাফল গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনও সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে সফল ও আস্থাযোগ্য ছিল। ভোটাররা নিশ্চিত ছিলেন যে তারা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোট দিতে পারবে।
তবে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেনাবাহিনী কেবল নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কার্যকর হয়। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছিল, সমালোচকরা মনে করেন সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত প্রভাব গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর ছিল না। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিরোধী দলের অংশগ্রহণহীনতার কারণে আস্থাহীন ও সহিংস হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকলেও ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট ও ভোটারদের বাধার অভিযোগ উঠে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী নিরাপত্তা দিয়েও রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে পারেনি।
এ থেকে শিক্ষা স্পষ্ট—সেনাবাহিনী কেবল অস্থায়ী ভরসা দিতে পারে, স্থায়ী সমাধান নয়। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে দরকার শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সমঝোতা। সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তা দেয়, কিন্তু সংকট নিরসনের চাবিকাঠি রাজনীতির হাতেই।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সেনাবাহিনী মোতায়েনকে দ্বিমুখী দৃষ্টিতে দেখে। একদিকে এটি সহিংসতা কমানোর উপায়, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দুর্বলতার প্রমাণ। তাই টেকসই গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীলতা।
আসন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিরাপত্তার ইতিবাচক বার্তা দেবে। তবে যদি রাজনৈতিক দলগুলো আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, সেনাবাহিনী থাকলেও নির্বাচন ঘিরে সংকট অব্যাহত থাকবে। দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার একমাত্র পথ হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও সমঝোতা। সেনাবাহিনী আস্থার প্রতীক হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের বিকল্প নয়।
