সম্পাদকীয়: আজ ১২ রবিউল আউয়াল, পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.)। ১৪০০ বছরেরও বেশি আগে এ দিনেই মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্বনবী, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন এমন এক যুগে, যখন সমাজ ভেঙে পড়েছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার, নারী অবমাননা, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও গোত্রীয় হানাহানির অন্ধকারে। তাঁর আগমনে অমানবিকতার শৃঙ্খল ভেঙে মানবতার মুক্তি ঘটে।
কোরআনের আলোয় মহানবীর মিশন: আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ঘোষণা করেছেন—
“আমি তোমাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
আরেক স্থানে বলা হয়েছে—
“তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১)
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, মহানবীর জীবন শুধু ধর্মীয় নয়, বরং পূর্ণ মানবিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনা।
মহানবীর জীবন থেকে শিক্ষা: মহানবীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মানবতার জন্য আলোকবর্তিকা। শৈশবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন “আল-আমিন”—সৎ ও বিশ্বস্ত। ব্যবসায় সততার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন সমগ্র আরবে। জীবনের পরবর্তী সময়ে তিনি সমাজের দুর্বল ও নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিশুদের অধিকার রক্ষা করেছেন, দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়েছেন।
তিনি বলেছেন—
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ, যে তার স্ত্রী ও পরিবারের কাছে শ্রেষ্ঠ।” (সুনান আত-তিরমিজি)
আবার তিনি ঘোষণা করেছেন—
“মানুষ সকলেই আল্লাহর পরিবার; আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি প্রিয়, যে তাঁর পরিবারের (সকল মানুষের) প্রতি সবচেয়ে উপকারী।” (মুসলিম শরীফ)
বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিকতা: আজকের বিশ্বে আমরা প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর হলেও নৈতিকতা, মানবিকতা ও ন্যায়বোধে পিছিয়ে পড়েছি। সহিংসতা, দুর্নীতি, চরমপন্থা ও বৈষম্য সমাজকে গ্রাস করছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখায় মহানবীর শিক্ষা। তাঁর দেখানো সহনশীলতা, দয়া, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা ছাড়া একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ কল্পনাই করা যায় না।
করণীয়: আমরা প্রায়ই মিলাদুন্নবীকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা, শোভাযাত্রা বা আলোসজ্জার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। অথচ আজকের দিনে প্রকৃত করণীয় হলো—
নবীর শিক্ষা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক চর্চা বাড়ানো।
দুর্নীতি ও বৈষম্য থেকে মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা।
রাষ্ট্রীয় নীতি ও সামাজিক ব্যবস্থায় ন্যায়, দয়া ও মানবতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
মহানবীর জন্মোৎসব কেবল আনন্দের উপলক্ষ নয়, বরং আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির দিন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র—সব স্তরে তাঁর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই আমরা একটি শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
মিলাদুন্নবীর পবিত্র দিনে আমাদের শপথ হোক—হানাহানি নয়, শান্তি; বিভেদ নয়, ঐক্য; অন্যায় নয়, ন্যায়। মহানবীর আদর্শই হোক আমাদের পথের দিশারী।