নিজস্ব প্রতিবেদক: “মাস্টার্স পাস একজন যুবক চায়ের দোকান দিবেন”—এমন খবর শুনে অনেকেই প্রথমে অবাক হয়েছেন। কেউ ভ্রু কুঁচকে বলেছেন, “কফি শপ বা আধুনিক কোনো ক্যাফে হলে মানাতো, কিন্তু চায়ের দোকান?” কিন্তু সব কটূক্তি আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাহ্য করে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সৎ উপার্জন ও আত্মসম্মানের কাছে সমাজের কথার কোনো মূল্য নেই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শহীদুল রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ২০১৩ সালে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য বহু চেষ্টা করেছেন। আবেদন করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাননি। হতাশ না হয়ে একসময় ফ্রিজের দোকান খোলেন। কিছুটা সময় সেই ব্যবসা চালালেও সফল হতে পারেননি। এরপর ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা করতে করতেই অনলাইন স্কুল গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতার চাপে সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর শহীদুল সিদ্ধান্ত নেন, চায়ের দোকান দেবেন। তবে এই সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না। পরিবার থেকে পরামর্শ এসেছিল—যদি করতেই হয়, তবে অন্তত একটি ক্যাফে হোক। কিন্তু তিনি নড়েননি। অক্টোবরের শুরুতে রাজধানীর ভাটারা কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে যাত্রা শুরু করে তাঁর দোকান ‘এমএ পাস চাওয়ালা’। দোকান ভাড়া করতেও অনেক বাধা পোহাতে হয়েছে। মালিকেরা যখনই জানতে পারতেন দোকানটি হবে চায়ের, তখনই অনীহা প্রকাশ করতেন। কেউ কেউ আবার ফোনেই আর যোগাযোগ করতেন না। কিন্তু এসব বাধাই শহীদুলের জেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, “এই নামের পেছনে দুটি কারণ আছে। প্রথমত, নাম শুনেই যেন সবাই আকৃষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত বেকার তরুণরা যেন অনুপ্রাণিত হয় এবং কোনো কাজকে ছোট না ভাবে।”
দোকানটি সাজানো হয়েছে বেশ যত্ন নিয়ে। তামার কেতলি, চা তৈরির সরঞ্জাম, পরিপাটি আসবাব—সব মিলিয়ে দোকানটির পরিবেশ আলাদা। প্রতিদিন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা ভিড় করছেন এখানে। চায়ের তালিকাও বৈচিত্র্যময়—ইরানি জাফরান চা, ইরানি দুধ চা, স্পেশাল মাসালা দুধ চা, গরুর দুধ চা—সবই মিলছে স্বল্প দামে। সঙ্গে রয়েছে মাংসের স্পেশাল শিঙাড়া। এছাড়া আইস টি, মকটেল, জুস, লাচ্ছি, মিল্ক শেক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, মটু শর্মা ও মটকা মিট বক্সও রাখা হয়েছে।
পাশের মুদি দোকানের কর্মী মানিক বলেন, “এমএ পাস চাওয়ালা নামটাই আলাদা। এতে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক উৎসাহ পাবে। বসে না থেকে নিজের মতো কিছু করবে।” তাঁর মতে, অনেকেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে ছোটখাটো কাজ করলে তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। কিন্তু শহীদুল সেই মানসিকতার বেড়াজাল ভেঙে ফেলেছেন। তাই তিনি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা।
শহীদুলের এই যাত্রায় সবচেয়ে বড় প্রেরণা তাঁর স্ত্রী শ্যামলী আক্তার। তিনি সবসময় স্বামীর পাশে থেকেছেন, সংকটের সময়ে ভরসা ও সাহস যুগিয়েছেন। শহীদুলও অকপটে তা স্বীকার করেন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ‘এমএ পাস চাওয়ালা’ আলোচনায় এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা। অনেকেই মনে করছেন, শহীদুলের এই উদ্যোগ শিক্ষিত বেকার যুবকদের নতুন দিশা দেখাবে। প্রমাণ করবে—কোনো কাজ ছোট নয়; অসৎভাবে আয় করাই লজ্জার।