ভোরের দূত ডেস্ক:
বাংলাদেশে পুরুষরা ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও অনেক সময় এই ঘটনা উপেক্ষিত থেকে যায়। ভুক্তভোগীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা কম, কারণ দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পুরুষ ধর্ষণের শিকার হলে সরাসরি কোনো বিধান নেই। বিচার করার জন্য প্রযোজ্য হয় ভিন্ন আইন, যার কারণে প্রকৃত এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
নারায়ণগঞ্জে গত ৮ই মার্চ একটি উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটে। ২০ বছর বয়সী এক তরুণ স্থানীয় প্রতিবেশীর হাতে ধর্ষণের শিকার হন। তিন দিন পর, ১১ই মার্চ, বন্দর থানায় মামলা নথিভুক্ত করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন ভুক্তভোগীকে প্রতিবেশী নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক তৈরি করেছে।
এমন ঘটনায় মামলা রুজু করা হয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায়, যা প্রকৃতির বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৬ বছরের উপরে ছেলেদের ধর্ষণের জন্য আলাদা আইন না থাকায় এটি একমাত্র প্রযোজ্য ধারার মাধ্যমে মামলা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে ১৮ বছর পর্যন্ত ১১১ জন ছেলে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে কেবল ৫৫টি মামলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে সচেতনতা না থাকার কারণেই এখনও পুরনো আইনের মাধ্যমে বিচার হয়, ফলে ভুক্তভোগীদের যথাযথ সুরক্ষা বা বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না।
সিনিয়র আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্না বলেন, “ছেলেদের সাথেওতো এটি জোরপূর্বক ঘটানো হচ্ছে। ফলে এক্ষেত্রেও সমান শাস্তিই হওয়া উচিৎ।” বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান আরও বলেন, “তৃতীয় লিঙ্গের কেউ ধর্ষণের শিকার হলে তার জন্যও আলাদা কোনো আইন নেই। কিন্তু তাদেরও বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।”
প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সংজ্ঞা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় নির্ধারিত। এখানে বলা হয়েছে, কেবল একজন নারীই ধর্ষণের শিকার হতে পারে। “কোনো ছেলে যদি ধর্ষণের শিকার হন, তার জন্য আইনে কোনো বিধান নেই”, মন্তব্য করেন ইশরাত হাসান।
ধর্ষণের মামলা করার ক্ষেত্রে ধারা ৩৭৭ অনুযায়ী শাস্তির সীমাও আসে ভিন্নতা। যেমন, ৩৭৫ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড। অন্যদিকে, ৩৭৭ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি শুরু হয় ১০ বছর থেকে, সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আইনজীবীদের মতে, ধর্ষণের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল থাকা দরকার। কারণ “এটি অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে মেলে না। ল্যাব থেকে রিপোর্ট আসতেই চার-পাঁচ মাস লাগে। আইনে যতই ৯০ দিনে বিচার করার বিধান থাকুক, বাস্তবে তা কার্যকর করা সম্ভব হয় না।”
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা আরও বলেন, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিভাগে অন্তত একটি মেডিক্যাল ও ডিএনএ ল্যাব থাকা জরুরি। এছাড়া আইনের ফাঁক ও সময়সাপেক্ষ ব্যবস্থা দূর করতে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের ওপর জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী পুরুষদের ধর্ষণের চিত্র প্রায় একই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান RAINN-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ধর্ষণের শিকার প্রতি ১০ জনে একজন পুরুষ। ন্যাশনাল সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স রিসোর্স সেন্টারের (NSVRC) তথ্য অনুযায়ী, ২৪.৮ শতাংশ পুরুষ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন, এবং তাদের মধ্যে চারজনের একজন ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে প্রথমবার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২২৬ জন ছেলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে মামলা করা হয়েছে ১৪৬টি। ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ২৪ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ১৪টি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনকে লঘু করার সুযোগ নেই। ঘটনা নারীর ক্ষেত্রে হোক বা পুরুষের ক্ষেত্রে হোক, আইনের কার্যকরতা এবং সমান শাস্তি নিশ্চিত করতে এখনই সংস্কার করা জরুরি।