সম্পাদক: বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। এ সময় শুধু রাজনীতির প্রেক্ষাপট নয়, বরং গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সামাজিক মুক্তির প্রশ্নে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। লাখো ছাত্র–জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে। রক্ত ঝরেছে, প্রাণ দিয়েছে অনেকে, তবু আন্দোলনের আগুন নিভে যায়নি। এই অগ্নিঝরা সময়ে প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের মতোই সমাজের নতুন এক শক্তিরও ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল—কনটেন্ট নির্মাতারা। তাদের কণ্ঠস্বর মুহূর্তেই লাখো তরুণের কাছে পৌঁছে যায়। তারা শুধু বিনোদন দেন না, বরং এক অদৃশ্য “অভিমত নির্মাতা” হয়ে উঠেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে—এত বড় এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মুহূর্তে তারা কী করেছেন?
প্রভাবশালী অবস্থান ও প্রত্যাশিত ভূমিকা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট নির্মাতাদের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। আজকের তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ তাদের অনুসরণ করে, তাদের কথায় অনুপ্রাণিত হয়, আবার অনেক সময় তাদের দ্বারা বিভ্রান্তও হয়। সুতরাং, সংকটময় মুহূর্তে তাদের ভূমিকা নিছক ব্যক্তিগত নয়; এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বের জায়গা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
এই অভ্যুত্থানের সময় তাদের দায়িত্ব ছিল আন্দোলনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, ভ্রান্তি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। তারা চাইলেই তাদের প্ল্যাটফর্মকে বিকল্প গণমাধ্যমে রূপান্তরিত করতে পারতেন—যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত সংবাদ প্রবাহকে ভেদ করে পৌঁছে যেত সত্য। তাদের ক্যামেরা হতে পারত ইতিহাসের নতুন দলিল, আর তাদের কণ্ঠ ছাত্র–জনতার স্লোগানের সঙ্গে মিশে যেত।
বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা: কিন্তু বাস্তবতা ছিল অনেকাংশে ভিন্ন। সত্যি বলতে, কনটেন্ট নির্মাতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্বৈত। কেউ কেউ সাহসিকতার সঙ্গে আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের কনটেন্ট আন্দোলনকারীদের প্রেরণা জুগিয়েছে, জনমত গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। তারা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নাম লিখিয়েছেন।
কিন্তু অধিকাংশই থেকেছেন নীরব। কেউ জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে নিরপেক্ষতার আড়ালে লুকিয়েছেন, কেউ আবার রাষ্ট্রীয় চাপে নিজেদের অবস্থান আড়াল করেছেন। কেউ কেউ এমন কনটেন্টও তৈরি করেছেন যা আন্দোলনের গুরুত্বকে খাটো করেছে কিংবা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। অনেকে আবার পরিস্থিতিকে বিনোদনের উপাদান বানিয়ে ক্ষণস্থায়ী ভিউ ও লাইক কুড়িয়েছেন। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভাজন তৈরি হয়েছে, ছাত্র–জনতার সংগ্রামের শক্তি অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
এখানে বড় শিক্ষা হলো—জনপ্রিয়তা সব সময় দায়মুক্তি দেয় না। বরং জনপ্রিয়তার সঙ্গে দায়িত্ববোধও বেড়ে যায়। নীরবতা বা উদাসীনতা যে নিরপেক্ষতা নয়, তা ইতিহাসই শিখিয়ে দেয়।
দ্বৈত বাস্তবতা: এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে কনটেন্ট নির্মাতারা এক দ্বৈত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তারা যেমন ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করতে পারতেন, তেমনি তাদের নীরবতা বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করতে পারতো। কেউ আলো ছড়ান, আবার কেউ আঁধারকে ঘনীভূত করেন।
অন্যদিকে এটাও সত্য যে, তাদের ভিন্নমত বা সমালোচনাও গণতান্ত্রিক চর্চাকে সমৃদ্ধ করে। বিতর্ক সব সময় নেতিবাচক নয়। যদি তা দায়িত্বশীল ও গঠনমূলক হয়, তবে সেটি আন্দোলনকে আরও প্রাজ্ঞ ও সুসংগঠিত করতে পারে। কিন্তু যখন সমালোচনার আড়ালে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, তখন তা আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়।
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা: এই অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে যে জনপ্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ইতিহাস দীর্ঘস্থায়ী। কনটেন্ট নির্মাতারা বিনোদনের মাধ্যমে অনুসারী পেতে পারেন, কিন্তু সামাজিক আন্দোলনের মুহূর্তে তাদের অবস্থানই নির্ধারণ করে দেবে তারা ইতিহাসে কোথায় দাঁড়াবেন।
ছাত্রদের হাতে যে মশাল জ্বলেছিল, তা কেবল তাদের নয়; সেই আলোয় কনটেন্ট নির্মাতাদের ক্যামেরাও শামিল হতে পারত। কিন্তু অনেক ক্যামেরা নীরব থেকেছে। অনেকেই ভিউ গুনেছেন, ইতিহাস গোনেননি। এই নীরবতা ভবিষ্যতে প্রশ্ন হয়ে থাকবে—তারা কি সত্যের পাশে দাঁড়াবেন, নাকি আবারও নিরাপদ দূরত্বে থেকে কেবল বিনোদনের হিসাব করবেন?
সর্বোপরি: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে কনটেন্ট নির্মাতাদের ভূমিকা অবহেলা করার সুযোগ নেই। তারা শুধু জনপ্রিয় বিনোদনদাতা নন, তারা সমাজের প্রভাবশালী কণ্ঠ। তাদের উচিত সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো, জনগণের কণ্ঠস্বরকে আরও শক্তিশালী করা।
ইতিহাসের দায় এড়ানো যায় না। আগামী দিনে কনটেন্ট নির্মাতারা কি কেবল ভিউ আর লাইক গুনবেন, নাকি সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের অংশ হবেন—এটাই হবে তাদের আসল পরীক্ষা। কারণ বিনোদন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু দায়িত্বশীল অবস্থান চিরস্থায়ী।