ভোরের দূত ডেস্ক: আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএমআরএফ) জানিয়েছে, দেশে গত নয় বছরে বহু পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং বর্তমান পরিস্থিতি আরও গুরুতর। ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত নয় বছরে সারা দেশে ৪ হাজার ২৬৮ জন এবং কেবল নারায়ণগঞ্জ জেলায় ২ হাজার ৩২৮ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সংস্থাটি বলছে, বাস্তবে নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
বিএমআরএফ চেয়ারম্যান শেখ খায়রুল আলম সোহেল মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) জানান, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশের পুরো এলাকায় ১ হাজার ৬৭ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ পেয়েছে তাদের সংগঠন। পূর্ববর্তী বছরে (২০২৩) ১ হাজার ৪৯ জন, ২০২২ সালে ৭৯২ জন, ২০২১ সালে ৪৫০ জন, ২০২০ সালে ৩৩০ জন, ২০১৯ সালে ২৪০ জন, ২০১৮ সালে ১৭০ জন, ২০১৭ সালে ১২০ জন এবং ২০১৬ সালে ৫০ জন অভিযোগ পাওয়া যায়—এমন তথ্য দেন তিনি। এই হিসাব মিলিয়ে গত নয় বছরে মোট ৪ হাজার ২৬৮ জনের কথা উঠে এসেছে। তবে সংস্থার দাবি, লোকলজ্জা ও সামাজিক হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে অনেকে ঘটনাগুলো প্রকাশ করেন না; ফলে প্রকৃত সংখ্যা দফতরীয় হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি হবে।
নারায়ণগঞ্জে পরিস্থিতি আরও তীক্ষ্ণ বলে সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে ৬৪৭টি অভিযোগ পেয়েছে বি এম আর এফ। ২০২৩ সালে ৬৩২ জন, ২০২২ সালে ৩৯৭ জন, ২০২১ সালে ২১২ জন, ২০২০ সালে ১৫৩ জন, ২০১৯ সালে ১১৭ জন, ২০১৮ সালে ৮২ জন, ২০১৭ সালে ৬৫ জন এবং ২০১৬ সালে ২৩ জন—এভাবে মিলিয়ে গত নয় বছরে নারায়ণগঞ্জে মোট ২ হাজার ৩২৮ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে সংস্থার পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
বিএমআরএফ চেয়ারম্যান কহবেন—পুরুষদের অধিকার রক্ষা এবং নির্যাতন প্রতিরোধে তাদের সংগঠন কাজ করছে। তাঁর ভাষ্য, “গবেষণায় দেখা গেছে সারাদেশে গত কয়েক বছরে গড়ে প্রায় এক হাজারের অধিক—আর নারায়ণগঞ্জে প্রায় ছয়-সাতশ—পুরুষ প্রতি বছর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিবাহিত পুরুষরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন; প্রায় ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছেন—তবে বাস্তবে সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি।” তিনি আরও বলেন, অনেকে লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়ে এসব কথা প্রকাশ করে না এবং তাদের সংগঠন আইনি সহায়তা ও প্রতিরোধমূলক কাজ করে আসছে।
আইনের অপব্যবহারের ফলেই পুরুষ নির্যাতন বাড়ছে—এমন উল্লেখও করেছেন তিনি। সোহেল বলেন, “নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন প্রতিরোধ আইন থাকলেও পুরুষ নির্যাতন আইন নেই; ফলে নারী নির্যাতন আইন অপব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে অনেক পুরুষ মিথ্যা মামলার শিকার হচ্ছে, হয়রানির শিকার হচ্ছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে না গাহনের পরিণতি আত্মহত্যায় পৌঁছায়—তবু লোকলজ্জার ভয়ে তারা এ কথা বলতে পারেন না।” তিনি বলেন, একাধিক অভিযোগ নিয়মিতভাবে তাদের সংগঠনের কাছে আসে, কিন্তু মানুষ প্রকাশ্যে বলতে রাজি হন না। ফাউন্ডেশন পুরুষ নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে থাকছে।
নিজের ব্যক্তিগত কষ্টও জানিয়েছেন সোহেল। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে পারিবারিক প্রেক্ষাপটে তাঁর বিয়ের পর স্ত্রীর সম্পৃক্ততায় বিরোধের প্রেক্ষিতে যে যৌতুক-সংক্রান্ত মিথ্যা মামলা করা হয়—তার ফলে তাকে আটক-নির্যাতন ও জেল ভোগ করতে হয়েছে। তিনি দাবি করেন, পুলিশের কোনো পর্যায়ে ঘটনার ন্যায় ন্যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে পুলিশ-চলচ্চলনের কারণে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্ত হলেও নতুন মামলা ও ওয়ারেন্টের মুখে ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেন তিনি—পরবর্তীতে সমস্যা সমাধানের জন্য কাবিনের দ্বিগুণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছেন, এইরকম ব্যক্তিগত কাহিনি দেশের বহু পুরুষের ক্ষেত্রেই ঘটছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য নেওয়া হলে মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ জেলার সহসভাপতি অ্যাডভোকেট হাসিনা পারভীন কালবেলাও বলেন, সমাজে নারীরাও বেশি নির্যাতনের শিকার হয় এবং বিশেষ করে সাইবার ক্রাইমে নারীরা অনেক দুর্ভোগ ভোগ করছেন। তিনি স্বীকার করেন যে কিছু অসাধু নারী আইনের অপব্যবহার করছেন, তবে তিনি মনে করেন সেই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তিনি যোগ করেন, “আমরাও চাই প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পাক। নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও তাদের অধিকার পাওয়া দরকার।”
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আবুল কালাম আজাদ জাকির বলেন, দেশের যৌতুকভিত্তিক মামলার অধিকাংশই প্রলুব্ধতা বা অন্য কোনো পারিবারিক কারণে করা হয় এবং এতে অপপ্রয়োগ ঘটে। তিনি বলেন, “ভারত উপমহাদেশের সামাজিক কাঠামোই পুরুষতান্ত্রিক—বিগত সময়ে নারী নির্যাতিত হতেন বেশি; ফলে নারী নিরাপত্তার জন্য বহু আইন করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় কিছু মামলাকে নিয়ে অপপ্রয়োগ হচ্ছে; সহস্রেই সাধারণ গৃহবিবাদকে কেন্দ্র করে নারী নির্যাতনের অভিযোগ হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ-তদন্তে সকলের জন্য সমান আচরণ হওয়া উচিত।” তিনি আরও বলেন, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হবেই।
বিগত নয় বছরের সংখ্যাগত তথ্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-উক্তি ও সামাজিক পর্যালোচনা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশন একটি তীক্ষ্ণ সতর্কবার্তা দিচ্ছে: পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি সমাজে পর্যাপ্তভাবে বিবেচিত হচ্ছে না; আইনি শিকড়, সামাজিক মানসিকতা ও রিপোর্টিংয়ের ঘাটতির কারণে প্রকৃত পরিসংখ্যান লুকিয়ে আছে; এবং পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধে আলাদা আইনি ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে।