ভোরের দূত ডেস্ক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, প্রচারণার অভাব এবং সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার ত্রিমুখী চাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত এখন অস্তিত্ব সংকটে। বিদেশি পর্যটক না আসায় ট্যুর অপারেটরদের ব্যবসা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে, এবং অনেক উদ্যোক্তা পুঁজি হারানোর শঙ্কায় ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পথে হাঁটছেন।
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর দেশে ‘টেকসই রূপান্তরের জন্য পর্যটন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হচ্ছে, কিন্তু এই খাতে বিরাজ করছে গভীর হতাশা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশ্লেষকরা এই বিপর্যয়ের পেছনে একাধিক পুঞ্জীভূত কারণকে দায়ী করছেন:
- ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও নেতিবাচক ভাবমূর্তি: গত বছর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও তৎপরবর্তী সহিংসতার চিত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এর ফলে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ২০টি দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি রেখেছে।
- সমন্বয়হীনতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা: পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিজম বোর্ড, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের তীব্র অভাব রয়েছে। অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে জটিলতা, ই-ভিসা চালু না হওয়া এবং বিমানবন্দরে পর্যটকদের হয়রানি একটি বড় সমস্যা।
- প্রচার ও ব্র্যান্ডিংয়ের ব্যর্থতা: বিদেশে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য পরিকল্পিত প্রচারণা অনুপস্থিত। ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ট্যাগলাইনটি আগ্রাসী বিপণন কৌশলের অভাবে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে।
- অবকাঠামোগত ঘাটতি: পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তাঘাট, মানসম্মত হোটেল-মোটেল এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব প্রকট। ড. শাকের আহমেদের মতে, কক্সবাজারে নাইট লাইফ, জাদুঘর, অ্যামিউজমেন্ট পার্কের মতো সুবিধা নেই।
- আঞ্চলিকভাবে পিছিয়ে পড়া: জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থার (ইউএনডাব্লিউটিও) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যেখানে মালদ্বীপ পর্যটন থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার এবং নেপাল ৮০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, সেখানে বাংলাদেশের আয় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় বিদেশি পর্যটকদের বুকিং ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমেছে। একটি শীর্ষস্থানীয় ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদেশি পর্যটক নির্ভর হওয়ায় অফিস চালানো দায় হয়ে পড়েছে এবং কর্মীদের ছাঁটাই করতে হচ্ছে।
উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা সংকট মোকাবিলায় একাধিক পরামর্শ দিয়েছেন:
- আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কাজে লাগানো: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিতে হবে।
- পরিকল্পিত অবকাঠামো: ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রাফেউজ্জামানের মতে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে কক্সবাজারে বিদেশিদের জন্য পরিকল্পিত আবাসন গড়ে তোলা সম্ভব।
- পর্যটনপণ্য উন্নয়ন: পর্যটন করপোরেশন বোর্ডের পরিচালক মহিউদ্দিন হেলাল বলেন, কক্সবাজারের আকর্ষণগুলো এখনো কাঁচামাল হিসেবে রয়েছে, সেগুলোকে পর্যটনপণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
- সরকারি আশ্বাস: বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান জানিয়েছেন, ‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সায়মা শাহীন সুলতানা জানান, ‘২০২৪ ট্যুরিজম পলিসি’ শিগগির অনুমোদিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পর্যটন টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি এবং এর মাধ্যমে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।
(বিস্ময়কর হলেও সত্য, দেশে বছরে কতজন বিদেশি পর্যটক আসেন, তার সুনির্দিষ্ট ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরকারের কাছে নেই।)