ভোরের দূত ডেস্ক: ৯ নম্বর পুরানা পল্টন। বাড়িটির দোতলায় থাকেন মিটফোর্ড হাসপাতালের বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। ১৯৭১ সাল। জুলাই মাস চলছে তখন।
.
কদিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছে তো চলছেই। থামার লক্ষণ নেই। সেই অঝোর বৃষ্টির মধ্যেই পিডিবির আব্দুল মতিন সাহেব হুট করে নিয়ে এলেন মাওলানা মান্নানকে। পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা মান্নান।
.
মতিন সাহেব গিয়ে ধরলেন আলীম চৌধুরীকে। তিনি ও তার পরিবার থাকেন বাড়ির দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে। নিচতলায় তার ব্যক্তিগত চেম্বার ও ক্লিনিক। চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি তখন দেশসেরা। তার চেম্বারে সিরিয়াল পাওয়াও বেশ শক্ত। কিন্তু, যুদ্ধের কারণে ক্লিনিকের কাজ বন্ধ।
.
আব্দুল মতিন সাহেবের আবদার, ‘এই মাওলানা সাহেব পরিবার নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছেন। চাকরি নেই, আর্থিক অনটন। কোথাও যেতে পারছেন না। তার গ্রামের ঘরবাড়ি কে বা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। একেবারেই নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছেন। এই মুহূর্তে আশ্রয় না দিলে ভদ্রলোক খুবই অসুবিধায় পড়বেন। যদি একটু আশ্রয় দেওয়া যায় নিচ তলায়।’
.
আলীম চৌধুরী শুনলেন। দ্বিমত না করেই প্রস্তাবটা তুললেন স্ত্রী নাসরিনের কাছে। নাসরিন শুনেই রেগে আগুন। স্ত্রী বললেন, ‘না। তোমার চেম্বারের কি হবে? চেম্বার তুলে ওই লোককে থাকতে দিবে? তুমি পাগল না মাথা খারাপ হয়েছে?’
আলীম চৌধুরী বললেন, ‘মাত্র কটা দিন, অন্যত্র ব্যবস্থা হলেই চলে যাবেন তিনি। একটা মানুষ বিপদে পড়ে এসেছেন, আর আমরা তাকে আশ্রয় দিবো না!’
.
এবারও নাসরিনের দৃঢ় জবাব ‘না’! স্ত্রীর ‘না’ বলার জোর দেখে ডা. আলীম আর কথা বাড়ালেন না। নিচে নেমে গেলেন তাদের মানা করে দিতে। কিন্তু, মতিন ও মান্নানের কাকুতি-মিনতি শুনে আবার উপরে উঠে এলেন তিনি। আলীম এবার তার মাকে অনুরোধ করলেন নাসরিনকে রাজি করানোর জন্য।শাশুড়ির অনুরোধ ফেলতে পারলেন না নাসরিন। বললেন, ‘ঠিক আছে থাকুক। তবে, কদিনের মধ্যে যেন অন্য জায়গায় আশ্রয় খুঁজে নেয়!’
.
তো মাওলানা মান্নানের থাকার ব্যবস্থা হলো। এবার খাওয়ার ব্যবস্থা? তাও এলো আলীম চৌধুরীর বাসা থেকে। আলীম চৌধুরীর বাসায় যা রান্না হয় তার একভাগ মাওলানা মান্নানের জন্য নিচতলায় পাঠানো হয়। চেম্বার সরিয়ে ওখানে এখন আলিশান বাসা।
.
দিন যায়, মাস যায়। মাওলানা মান্নানের ঘর ভর্তি ফার্নিচার, খাট-পালঙ্ক সবই আসে। কিন্তু, যাওয়ার কোনও নাম নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই মান্নানের বাসায় শুরু হয় অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা, হৈচৈ, ফিসফিসানি। উপর থেকে শুনতে পান নাসরিন। বুঝে ফেলেন কাকে তারা আশ্রয় দিয়েছেন। এদিকে সারারাত মান্নানের বাসায় লোক আসছে যাচ্ছে, আড্ডা চলছে। পালিয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই আলীম চৌধুরীদের।
.
এর মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে একটা উড়ো চিঠি এলো মাওলানা মান্নানের কাছে। চিঠিতে লেখা, ‘আলীম ভাই উপরে না থাকলে তোকে কবেই বোমা মেরে উড়িয়ে দিতাম।’
এরপর থেকে ডা. আলীম চৌধুরীর বাসার নিচতলায় সিঁড়ি দরজার বাইরে দুজন আলবদর দিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারা বসানো হলো মান্নানের জন্য।
.
ব্যাপারটা যেন আলীম চৌধুরীর পরিবার না বুঝতে পারে সেজন্য মান্নানের গেটেও পাহারায় ছিল চার-পাঁচ জন। এদিকে ভেতরে ভেতরে চাল চলছে। উপরে উপরে আলীম চৌধুরীর সামনে পড়লেই মাওলানার সে কী অমায়িক ব্যবহার।
.
দেখা হলেই বলে, ‘ডাক্তার সাহেব, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলব না। আপনার কোনো ভয় নাই। আপনার কোনও বিপদ হবে না। যদি কখনও কোনও অসুবিধায় পড়েন, সোজা আমার কাছে চলে আসবেন। আমি আপনাকে রক্ষা করব। আমার জীবন থাকতে আপনার কোনও ক্ষতি কেউ করতে পারবে না।’
.
এদিকে চেম্বারও নেই আলীম চৌধুরীর। হাসপাতালেই কাটে তার সময়। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় তখন ভারতীয় বিমান হরদম বোমা বর্ষণ করছে। কারফিউও চলছে। শুধু সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত কারফিউ থাকে না। দেশের অবস্থা সুবিধার না। আলীম চৌধুরীকে বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনেরা অনুরোধ করছেন উনি যেন অন্য কোথাও আশ্রয় নেন। রাজাকারেরা তাকেও মেরে ফেলতে পারে।
.
প্রথমে আলীম চৌধুরী বললেন, ‘আমাকে কেন মারবে। আমি তো একজন ডাক্তার। লোকের সেবা করি।’তবু স্ত্রী ও বন্ধুদের চাপে তিনি ভাবলেন, এই ফাঁকে একবার অন্য কোনও জায়গায় আশ্রয় নেওয়া যায় কি না দেখে আসবেন। হাসপাতালটাও ঘুরে আসবেন।
.
নাসরিনের ইচ্ছা ছিল না তখন তিনি বের হন। আলীম চৌধুরীর জেদ তিনি বের হবেনই। নাসরিনকে বললেন, ‘আমাকে তো একবার হাসপাতালে যেতেই হবে। ডাক্তার মানুষ আমি যদি না যাই তো কে যাবে?’
.
তারপর বললেন, ‘আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি ফিরব। তুমি তৈরি থেকো। আমি ফিরলে সবাইকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব।’ নাসরিন বললেন, ‘তুমি ঠিক মতো ফিরবে? তাহলেই হয়েছে। তুমি কারফিউর সময় পার করে দিয়ে আসবে। আর আমাদেরও যাওয়া হবে না! জলদি ফিরে এসো, দেশের অবস্থা ভালো না।’
.
আলীম চৌধুরীরও এক কথা, কারফিউর অনেক আগেই তিনি ফিরবেন। তারপর কেরোসিনের একটি টিন নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। বাসায় তখন কেরোসিনের অভাব।
.
গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে গেলেন ডা. চৌধুরী। হাসপাতালে সহকর্মীরা তো তাকে দেখে অবাক। এই দুর্যোগের মধ্যে উনি কিনা এসেছেন হাসপাতালে। তারা বলে উঠলো, ‘স্যার, আপনি যখন এসেই পড়েছেন, তখন আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না। এখানেই থেকে যান।’ আলীম চৌধুরী বললেন, ‘না, না, বাসায় সবাইকে রেখে এসেছি। বাড়ি ফিরে ওদেরকে নিয়ে আবার বেরুতে হবে।’
.
এরপর আলীম চৌধুরী গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডা. লতিফের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য যদি একটা সাময়িক আশ্রয়ের বন্দোবস্ত হয়। তখন অনেক চিকিৎসক সপরিবারে হাসপাতালের কেবিনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ডা. আলীম চৌধুরীও সেরকম একটা আশ্রয় চাচ্ছিলেন। কিন্তু ডা. লতিফ তাকে সে রকম কোনও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে রাজি হলেন না।
.
এরপর আলীম চৌধুরী কী আর করবেন! হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ভাইয়ের ছেলের বাসায় গেলেন কেরোসিন আনতে। কেরোসিন নিলেন। তেলের দাম দিলেন। দাম পেয়ে ভাইপো তো হেসেই অস্থির। ‘হায়রে কাকা; তেলের দামও দিতে হচ্ছে!’ আলীম চৌধুরীর সাফ জবাব, ‘দেখ, মানুষের মরার কথা তো বলা যায় না। এই এখন আমাকে দেখছিস। কিন্তু, কিছুক্ষণ পর আমি তো নাও বেঁচে থাকতে পারি।’
.
সেখান থেকে আলীম চৌধুরী বাড়ি ফেরার জন্য গাড়িতে উঠবেন, ঠিক তখনই কারফিউর সাইরেন বেজে উঠলো। ভাইপো তার হাত ধরে থেকে যেতে বলল। কিন্তু আলীম চৌধুরী জানালেন, যেভাবেই হোক তাকে বাসায় যেতেই হবে। বললেন, ‘আমার গাড়িতে রেডক্রস চিহ্ন আছে। কিছু ভেবো না। আমি ঠিক ঠিক বাসায় পৌঁছে যাবো।’
.
বাসায় ফিরতেই নাসরিনের মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠলো। লোকটা এতক্ষণে ফিরেছে তাহলে! প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে নাসরিন বললেন, ‘কি বলেছিলাম, সেই কারফিউ পার করে দিয়েই তো ফিরলে।’ আলীম চৌধুরী বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে। কাল একেবারে সক্কালেই চলে যাব।’
.
পরদিন ১৫ ডিসেম্বর দুপুর দুটো থেকে আবার বোমা বর্ষণ শুরু হলো। দোতলার বারান্দায় বসে সেই বোমা বর্ষণ দেখছেন আলীম চৌধুরী। বলছেন, ‘দেখো, পাকিস্তানিরা বোকার স্বর্গে বাস করছে। ভারতীয় বিমানগুলোকে বাঁধা দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই। দেখো, দেখো, বিমানগুলো ইচ্ছেমতো বোমা ফেলছে। আর এখনও মাওলানা মান্নানের মতো পাকিস্তানিরা বলে কিনা আমেরিকা তাদের রক্ষা করবে। সপ্তম নৌবহর নাকি এসেছে।’ বলেই প্রাণ খুলে হাসলেন তিনি।
.
অনেক দিন অনিশ্চয়তায়-আশঙ্কায় এই হাসি তিনি হাসতে পারেননি। আজ তিনি নিশ্চিন্ত। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘দেখো, আর দুয়েক দিনের মধ্যেই আমরা স্বাধীন হয়ে যাব।’
.
বিকেল তখন সাড়ে চারটা। বিমানগুলো তখন পিলখানার দিকে বোমা ফেলছিল। সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন ডা. আলীম, তার স্ত্রী ও মা। খুব কাছেই একটা গাড়ির শব্দে তাদের মনোযোগ কেটে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কাদা মাখানো একটা ছোট মাইক্রোবাস এসে নিচতলায় মাওলানা মান্নানের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার কাছে এ রকম মাইক্রোবাস প্রায় প্রতিদিনই আসে। এ ধরনের মাইক্রোবাস যতবার এসে গেটে দাঁড়ায় ততবারই একটা আশঙ্কা হয়।
.
কয়েকজন ছেলেপুলে নামলো মাইক্রবাস থেকে। নাসরিন একটু উঁকি দিয়ে দেখলেন। তখন আলীম চৌধুরী বললেন, ‘অতো উঁকিঝুঁকি দিয়ো না। ভেতরে যাও। বোধহয় আর্মি এসেছে মাওলানার বাসায়।’এ কথা বলেই তিনি বাথরুমে গেলেন।
.
নাসরিন স্পষ্ট দেখতে পেলেন নীল শার্ট আর ছাই রংয়ের প্যান্ট পরা তিন জন ছেলে। তিনি দেখেই বুঝলেন ওরা কারা। ব্যাপারটার তেমন গুরুত্ব দেননি দুজনেই। কারণ মাওলানা মান্নানের বাসায় প্রতিদিন এমন লোক আসছে-যাচ্ছে। বাথরুম থেকে তিনি বেরিয়েছেন, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
.
আলীম চৌধুরীর মনটা কেমন শঙ্কিত হলো। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এলোমেলোভাবে বললেন, ‘ও, এসেছে। তা দরজা খুলে দাও।’ বাড়ির কাজের ছেলেকে দরজা খুলে দিতে বললেন নাসরিন। দরজা খুলতেই আলীম চৌধুরী নিচে নামতে লাগলেন। আলীম চৌধুরীর মা বলে উঠলেন, ‘আরে কোথায় যাচ্ছিস?’
.
তিনি বললেন, ‘নিচে, মাওলানার কাছে। মাওলানা বলেছিল, এ ধরণের কোনও ব্যাপার হলে যেন তাকে জানানো হয়।’ নিচে নেমে তিনি মাওলানার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন। এমনিতে মওলানার দরজা সব সময় খোলা থাকত। কিন্তু, সেদিন দরজা ছিল বন্ধ।
.
আলীম চৌধুরী দরজা ধাক্কাচ্ছেন, চিৎকার করে বলছেন, ‘মাওলানা দরজা খুলুন।’ কিন্তু মাওলানার কোন সাড়াশব্দ নেই। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে বললেন, ‘ভয় পাবেন না ডাক্তার সাহেব। আপনি যান। আমি আছি।’ উপরে ওঠার জন্য পা বাড়ালেন ডা. আলীম। এমন সময়েই আলবদরের ছেলেদের আদেশ, ‘হ্যান্ডস আপ! আমাদের সঙ্গে এবার চলুন।’
.
‘কি ব্যাপার কোথায় যাবো?’ বললেন আলীম চৌধুরী।
‘আমাদের সঙ্গে চলুন।’
‘তা কোথায় যেতে হবে আমাকে?’
‘সেটা গেলেই জানতে পারবেন। চলুন।’
‘প্যান্টটা পরে আসি,’ বললেন আলীম চৌধুরী।
‘কোন দরকার নেই।’
আলীম চৌধুরীকে নিয়ে তারা গেটের বাইরে যেতেই দৌঁড়ে দোতলায় উঠে এলো হাকিম আর মোমিন। নাসরিনকে বললেন, ‘সাহেবকে তো ওরা নিয়ে যাচ্ছে।’
.
কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না নাসরিন। এই এতদিনেও মান্নান লোকটার সঙ্গে কোনও কথা বলেননি তিনি। কোনোকিছু ভেবে না পেয়ে তার কাছেই ছুটে গেলেন। দরজায় কয়েকবার আঘাত করে ডাকতেই ভেতর থেকে সাড়া দিল মান্নান। দরজা খুলে দিল সে। মান্নান এই ফাঁকে একটু যেন দেখেও নিলো। ডাক্তারকে নিয়ে গাড়িটি বেরিয়ে গিয়েছে কিনা।
.
নাসরিন মান্নানের সামনে কাতর হয়ে অনুনয় করে বললেন, ‘মাওলানা সাহেব, গাড়িটা এখনও ছাড়েনি। আপনি একটু দেখুন। দয়া করে ওদের বলুন, ওকে যেন ওরা ছেড়ে দেয়।’ মান্নান নাসরিনের অনুনয় না শুনে সোফায় বসতে বসতে বাইরের দিকে কান পেতে ছিল। মাইক্রোবাস ছাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। গাড়ির শব্দে কান্না আর ধরে রাখতে পারলেন না নাসরিন।
.
গাড়ি ছাড়ার শব্দে নিশ্চিত হয়েই যেন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেল মান্নান। বলল, ‘অস্থির হবেন না। ওরা আমার ছাত্র। ওরাই উনাকে নিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার রাব্বিকেও নিয়ে গেছে।’ ডা. ফজলে রাব্বির নাম শুনে নাসরিন বললেন, ‘কেন নিয়ে গেছে? কোথায় নিয়ে গেছে?’ মান্নান বললেন, ‘নিয়ে গেছে সিএমএইচে।’
.
মান্নানের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে দোতলায় ফিরে এলেন শ্যামলী নাসরিন। ডা. রাব্বির স্ত্রীকে ফোন করতে চাইলেন। অনেক চেষ্টার পর পাওয়া গেল লাইন। ডা. রাব্বীর স্ত্রী বললেন, ‘চারটার দিকে তো রাব্বিকেও নিয়ে গেছে ওরা।’
.
কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বললেন, ‘ওরা কি আর ফিরবে?’
মিসেস রাব্বির কথায় আঁতকে উঠলেন নাসরিন। তার বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তের মধ্যে শূন্য হয়ে গেল। পুরো বাড়িটা যেন কয়েকবার দুলে উঠল। দ্রুত ফোন রেখে দিলেন। আবার ছুটে গেলেন মান্নানের কাছে। এবার সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘আপনি আমাকে সঠিক খবর দিন। ও কোথায় আছে?’
.
নাসরিনের কাছ থেকে এ রকম সোজাসাপ্টা প্রশ্ন শুনে খানিকটা মিইয়ে গেল মান্নান। বলল, ‘ভাবি সাহেব, এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। বললাম তো, চিকিত্সার জন্য নিয়ে গেছে। কাজ শেষ হলেই দিয়ে যাবে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।’
.
মান্নানের কথায় নাসরিন যেন আবার একটু আশ্বাস পেলেন। বললেন, ‘শীতের কাপড় নেয়নি। ওগুলো তাহলে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিন।’
মান্নান বলল, ‘সে ব্যবস্থা ওরাই করবে।’
.
নাসরিন আবার উপরে উঠে এলেন। রাত বাড়ছে। ঘুম আসছে না। কান পেতে বসে আছেন দরজার বেল শোনার জন্য। সামান্য খুটখুট আওয়াজেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেই যে উঠিয়ে নিয়ে গেল, আর ফিরে এলেন না আলীম চৌধুরী।
.
পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পরে এই মাওলানা মান্নান আশ্রয় নেয় আলীম চৌধুরীর বাসার রান্নাঘরে। তারপর সেখান থেকে পালিয়ে যায় সে। ১৬ ডিসেম্বর দেশজুড়ে চলছে বিজয়ের আনন্দ। কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকে পেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে হাজার হাজার মানুষ। মিছিলে সবার হাতে হাতে আর বাড়ির ছাদে উড়ছে নতুন পতাকা।
.
মিছিল দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন নাসরিন, ছুটে যাচ্ছেন আলীম চৌধুরীর দুই মেয়ে নুজহাত চৌধুরী শম্পা আর নীপা। ছুটে যাচ্ছেন হাফিজ। মিছিলের মুখগুলোতে তন্নতন্ন করে তারা খুঁজছেন একটি মুখ। যার এই মিছিলেই থাকার কথা। জনতার এই ঢলে ভেসে যাওয়ার আশায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে তিনি তো অপেক্ষায় ছিলেন।
.
এই মিছিল দেখার অপেক্ষায় প্রতিটি দিন প্রতিটি রাত কেটেছে তার। অথচ হাজার হাজার মানুষের মধ্যেও তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না নাসরিন, শম্পা, নীপা ও হাফিজ। পরিচিত লোকদের দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু, কেউ কোনও সন্ধান দিতে পারছে না।
.
অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর খোঁজ মিলল ডা. আলীম চৌধুরীর। ঠিক তার পাশেই পাওয়া গেল প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বীকেও। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে দুজনেরই দুচোখ আর দুহাত পেছনে গামছা দিয়ে বাঁধা; চোখ বাঁধার গামছাটা গলায় এসে ঠেকেছে। আলীম চৌধুরীর শার্টটা গায়েই ছিল।
.
পরনের লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে উঠে আছে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। ছড়ানো ছিটানো ইটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। পুরো শরীরে ছোপ ছোপ র’ক্ত। গালে, মাথায় বেয়নেট দিয়ে আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন। পেটে, বুকে গুলির দাগ। শরীরে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের চিহ্ন।
.
মনে পড়ে সেই বৃষ্টিভেজা জুলাই মাসের দিনটির কথা। যেদিন না বলেননি আলীম চৌধুরী। আশ্রয়হীন এক মাওলানাকে আশ্রয় দিতে নিজের জমজমাট চেম্বার অব্দি উঠিয়ে দিলেন, সেদিন কেবল একটা ‘না’ বললেই হয়তো এমন করে হারাতে হতো না এই নক্ষত্রসম মানুষটিকে। যে মাওলানা মান্নানকে দিনের পর দিন আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার পাঠিয়েছেন সেই মাওলানা মান্নানই ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হলো।
.
এই মাওলানা মান্নান পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক ইনকিলাব। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জমিয়ত-ই-মুদাররেসিনের সভাপতি হন। ১৯৭৯ সালে চাঁদপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মাওলানা মান্নান। এবং পরবর্তী এরশাদ আমলে মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
.
বিচার তো দূরে থাক, এই মাওলানা মান্নানের গাড়িতে উড়েছে জাতীয় পতাকা। তাকে পরিচিত করা হয়েছিলো পীর হিসেবে। ২০০৬ সালে শেষপর্যন্ত ঘৃণ্য এই নরপিশাচ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।
আজও মাওলানা মান্নানের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় তার নামের আগে লেখা হয় আল্লামা। আর নামের শেষে (রহঃ)। একটা দেশ কতোটুকু পচে গেলে ঘৃণ্য এক নর’ঘাতকের নাম আজও একইভাবে বর্তমান থাকে?