বাংলাদেশের চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল, প্রতিদিনই হচ্ছেন খুন ধর্ষণ

অপরাধ মতামত

ভোরের দূত ডেস্ক: মানুষের ধৈর্য ও সহনশীলতা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র বিষয়েও মেজাজ হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। এর ফলেই দেশে বাড়ছে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা। মানুষের জীবন আজ যেন তুচ্ছ কারণে ঝুঁকিতে পড়ছে। কে কখন কোন কারণে খুন হবে, তা আন্দাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খুন এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। মতবিরোধে খুন, প্রেমে বাধা পেলে খুন, পারিবারিক ঝগড়া থেকে খুন—সব জায়গাতেই প্রাণহানি ঘটছে। ডাকাতি, ছিনতাই আর আধিপত্য বিস্তার তো আছেই। যেন কথার জেরে খুন ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই।

সাম্প্রতিক দিনে রাজধানীসহ ফরিদপুর, বগুড়া, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার ও নেত্রকোনায় ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর পেছনে ছিল পারিবারিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, পূর্বশত্রুতা কিংবা ডাকাতির ছদ্মবেশ। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—খুনিরা প্রকাশ্যেই অপরাধ করছে। তাদের মধ্যে আইনের ভয় নেই বললেই চলে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা ও অপরাধীদের দ্রুত আটক করতে না পারার কারণে খুনিরা আরো দুঃসাহসী হয়ে উঠছে।

টাঙ্গাইলে বিএনপি নেতার স্ত্রী খুন: গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় বিএনপি নেতা আনিছুর রহমান উত্তমের স্ত্রী লিলি আক্তারকে মুখোশধারীরা কুপিয়ে হত্যা করে। স্থানীয়দের ভাষ্য, মগড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক উত্তম প্রতিদিন নামাজ শেষে ফ্যাক্টরিতে যেতেন। সেদিন তিনি দেরি করায় স্ত্রী তাকে খুঁজতে যান। ওই সময় আগে থেকে ওত পেতে থাকা তিন দুর্বৃত্ত লিলির ওপর হামলা চালায়। স্থানীয়রা এগিয়ে এলে তারা পালিয়ে যায়। লিলিকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ধারণা করা হচ্ছে, আসল লক্ষ্য ছিলেন উত্তম।

রাজধানীর আদাবরে কিশোর গ্যাংয়ের খুন: মঙ্গলবার ভোরে আদাবরের একটি বাড়িতে ঢুকে রিপন ওরফে নিপুকে কুপিয়ে হত্যা করে বেলচা মনির গ্রুপের কিশোর গ্যাং সদস্যরা। মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়েই এই সংঘর্ষ। গুরুতর আহত রিপন ঢামেকে ভর্তি হলেও সন্ধ্যায় মারা যান। সেনাবাহিনীর অভিযানে তিনজন ধরা পড়লেও মূল হোতারা পালিয়ে যায়।

ফরিদপুরে ভাগনের হাতে মামা খুন: ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ভাগনের হাতে খুন হয়েছেন আফসার শেখ। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। সূত্র জানায়, নিহতের দুই নাতি সুমন ও আবির ঝগড়ার পর বিষয়টি নিয়ে আফসার শেখ ভাগনের কাছে জানতে চান। এরপর ভাগনে হাসান ফকির ও তার সহযোগীরা আফসারকে ডেকে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

বগুড়ায় মা-ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা: বগুড়ার শিবগঞ্জে প্রবাসী ইদ্রীস আলীর বাড়িতে ঢুকে দুর্বৃত্তরা তার স্ত্রী রানী বেগম ও ছেলে ইমরান হোসেনকে হত্যা করে। সঙ্গে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকারও লুট হয়। নিহত ইমরান স্থানীয় স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। এ ঘটনা এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

মাদারীপুরে কলেজছাত্রকে প্রকাশ্যে খুন: শিবচরে শত মানুষের সামনে কলেজছাত্র রাকিব মাদবরকে ধারালো অস্ত্রে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মামলার পরও এখনো কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এলাকাবাসীর ভাষ্য, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে পূর্বের একটি হত্যা মামলার আসামি রাকিব জামিনে বের হয়ে এলাকায় ফেরেন এবং প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন।

কেরানীগঞ্জে দিনদুপুরে যুবক খুন: কেরানীগঞ্জে ছগীর নামে এক যুবককে দিনের আলোয় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, স্ত্রীর পরকীয়া নিয়ে বিরোধের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। স্থানীয়রা জানায়, দোকানে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা চালায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

কক্সবাজারে খুনের পর ধর্ষণ: কক্সবাজারে ভয়াবহ এক ঘটনায় বিরল চাকমা নামের ব্যক্তি প্রতিপক্ষ রঞ্জন চাকমাকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ধরা পড়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বিরল চাকমা ক্ষিপ্ত হয়ে এই ঘটনা ঘটান।

নেত্রকোনায় পাওনা টাকা নিয়ে খুন: নেত্রকোনায় পাওনা টাকা নিয়ে বিরোধের জেরে ১৯ বছরের জাহাঙ্গীরকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাকে রড ও লাঠি দিয়ে মারধরের পর গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিলে মারা যান।

বিশ্লেষণ: অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব হত্যাকাণ্ডের মূল প্যাটার্ন হলো পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ কিংবা আধিপত্য বিস্তার। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো প্রকাশ্যে মানুষের সামনে খুন হচ্ছে। অপরাধীরা শাস্তির ভয় হারিয়ে ফেলেছে।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সামাজিক অস্থিরতা খুন বাড়াচ্ছে। যতদিন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকবে, ততদিন এ প্রবণতা বন্ধ হবে না।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে, দ্রুত বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় সাধারণ মানুষ ভীত আর খুনিরা দায়মুক্তির সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খুন কমাতে হলে দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে, পারিবারিক-বিরোধ মীমাংসায় স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করতে হবে এবং পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করতে হবে।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া হত্যাকাণ্ড কমবে না। বিচারহীনতা বজায় থাকলে এ প্রবণতা কেবল বাড়তেই থাকবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *