মাসুদুর রহমান রুবেল, সাভার (ঢাকা): ঢাকার উপকন্ঠ শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া। যেখানে কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক এসে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু এই শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শুধু শ্রমিকরাই নয়, রয়েছে মাদককারবারিসহ সকল ধরনের অপরাধীরাও।
বর্তমানে এই অঞ্চলের অবস্থা এমন যেন, হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। দেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাদকের এমন সয়লাব দেখে বিস্মিত সচেতন মহল। কোনো ভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না মাদক কারবারিদের। মাঝে মধ্যে পুলিশের অভিযান ২/৪ জন গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগ প্রকাশ্যেই তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই এলাকার প্রতিটা অলিতে-গলিতেই মিলছে মাদক। মাদকের এই ভয়াল থাবায় নষ্ট হচ্ছে যুব সমাজ। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণে মাঝে মধ্যে পুলিশের অভিযান চোখে পড়লেও মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের অভিযান যেন আমাবস্যার চাঁদের মত।
এদিকে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার মাদক কারবারিরা জামিনে এসে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যারা খুচরা মাদক কারবারি ছিল, তারাই জেল থেকে বেড়িয়ে হয়ে যাচ্ছে মাদকের ডিলার। তাদের নতুন করে ব্যবসার ধরণ দেখে মনে তারা যেন জেলখানা থেকে মাদক বিক্রির লাইসেন্স নিয়ে ফিরে এসেছে।
আশুলিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা ধামসোনা ইউনিয়ন। আর এই ইউনিয়নের সবচেয়ে ঘনবসতি ৭নং ওয়ার্ড। আর এই ৭নং ওয়ার্ডের গাজিরচট বুড়ির বাজার, বগাবাড়ী আমতলা, বগাবাড়ী বাজার, বাইপাইল নামাবাজার, বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড, দক্ষিণ বাইপাইল, বসুন্ধরা টেক, চাড়ালপাড়া নামাপাড়া, বেলালনগর নামাপাড়া সহ অন্তত ৩০-৪০ টি চিহ্নিত মাদকের স্পট রয়েছে। যেখানে অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদক ক্রয়-বিক্রয় ও সেবন করা হয়।
এই ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের নাম ইয়ারপুর ইউনিয়ন। আর এই ইউনিয়নের নিশ্চিতপুর তালতলা, নরসিংহপুরের বুড়িপাড়া, জামগড়া, গোরাট, সরকার মার্কেট, ঘোষবাগের বাঁশতলা, ধনাঈদ ইউসুফ মার্কেট এলাকার সিগাম গার্মেন্টস এর পিছনে, বাগবাড়ী পাকা মাস্তার মাথায় মাদ্রাসা রোড গলি, বাগবাড়ি বটতলার মোড়, নিশ্চিন্তপুরের দেওয়ায়ন পাম্পের পিছনে খোলা মাঠসহ অন্তত ২০-৩০টি মাদকের স্পট রয়েছে। যেখানে প্রকাশ্যে মাদক সেবন সহ মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করা হয়।
এছাড়াও পাথালিয়া ইউনিয়নের নিরিবিলি, খেজুরটেক, কালারটেকসহ অন্তত ২০-৩০ টি স্পটে মাদকের প্রকাশ্য কারবার চলে। শিমুলিয়া ইউনিয়নের কলতাসূতি, মাজার রোড, রাঙ্গামাটি, আমতলা এলাকার ২০-৩০ টি স্পটে চলে মাদকের রমরমা কারবার। আশুলিয়া ইউনিয়নের বাসস্ট্যান্ড এলাকা, শুটিংবাড়ী, বস্তি এলাকা, চাড়াবাগসহ অন্তত ৩০/৪০ টি মাদকের চিহ্নিত মাদকের স্পট রয়েছে। যে সকল স্পটে হরহামেশাই মিলছে মাদক।
মাদক সেবনকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আশুলিয়ার অলিগলিতে সকল ধরনের মাদকদ্রব্যই পাওয়া যায়। যদি একটু বেশি পরিমানের মাদক দরকার হয় তাহলে, যারা মাদক বিক্রয় করে তাদের মোবাইলে কল দিলে নির্দিষ্ট জায়গার মত দিয়ে যায়। আবার দু’এক পুরিয়া হলে তাদের জায়গা মত গিয়ে নিয়ে আসি।
পুলিশ-প্রশাসনের বিষয়ে জানতে চাইলে? তারা বলেন, তাদের নজর ফাঁকি দিয়েই চলতে হয়। তবে বেশিরবাগ সময় পুলিশের ইনফরমারা আমাদেরকে পুলিশের অবস্থানের কথা আগে থেকে জানিয়ে দেয়। এভাবেই চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদক বিক্রেতা বলেন, অভিনব কায়দায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই মাদক গুলো আমরা নিয়ে আসি। যেমন চট্টগ্রাম ও টেকনাফ থেকে ইয়াবা এবং হেরোইন আসে। তেমনি বেনাপোল থেকে হেরোইন ও ফেনসিডিল আসে। তবে আমাদের এদিকে রাজশাহী থেকে ফেনসিডিল বেশি আসে।
কি কি ধরণের কৌশলে আনা হয়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সকল মাদকদ্রব্য বিভিন্ন কৌশলে আনা হয়। যেমন আমের ক্যারেটে, গ্যাসের বৌতলে, বিলাসবহুল গাড়িতে, যাত্রীবাহি বাসে। এই মাদকগুলো যেখানে থেকে পাঠায় তারা আমাদের জানিয়ে দেয়, তারা কিভাবে বা কার মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। পরে আমরা সেই তথ্যমত গিয়ে সংগ্রহ করি। অনেক সময় আমরা কিছু সংকেত বা ইশারাও ব্যবহার করি।
সমাজে মাদকের এমন ভয়াল থাবার বিষয়ে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর মুহাম্মদ ইসলাম উদ্দিন বলেন, মাদক সামাজিক একটা ব্যাধীতে রুপ নিয়েছে। এর ভয়াবহতা চরম আকার ধারন করেছে। এতে আমরা আসলে বিচলিত, মাদকের এই ভয়াল থাবায় কিশোর, যুবকসহ সকল বয়সের মানুষই জড়িয়ে পড়ছে।
এসময় তিনি আরও বলেন মাদক থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। যেমন- পরিবার, স্কুল, মসজিদ ও সামাজিক পর্যায়ে মাদকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করা। সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মিশে- এসব খেয়াল রাখা, তাদের সাথে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুবসমাজকে যুক্ত করা এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সেই সাথে সমাজে মাদক সেবন বা বিক্রির খবর পেলে সাহসের সাথে প্রতিবাদ করা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে কথা বলতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার পরিদর্শক নুসরাত জাহানের নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন কলটি রিসিভ করেননি।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) আব্দুল হান্নান বলেন, মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার করতে প্রতিনিয়ত আমাদের অভিযান অব্যহত আছে এবং ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন মাদককারবারিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরন করেছি।
এসময় তিনি গণমাধ্যম কর্মিসহ সমাজের সকল সচেতন মহলের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।