মাসুদ রহমান রুবেল, আশুলিয়া (ঢাকা): বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পোশাক শিল্প। লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম ও নিঃস্বার্থ শ্রমের মাধ্যমেই এই শিল্প আজ আন্তর্জাতিক বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে নিয়েছে।
তবে এই অর্জনের আড়ালে রয়েছে এক নির্মম বাস্তবতা—সুঁই, সুতা, কাপড় আর যন্ত্রপাতির ঘূর্ণাবর্তে বন্দি হয়ে আছে এসব শ্রমিকের জীবন। প্রতিদিন রুটিনমাফিক ক্লান্তিকর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাঁরা সচল রাখছেন দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রকে।
প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার বিস্তারে বাড়ছে অটোমেশন, কমছে শ্রমিকের প্রয়োজন। এতে যেমন উৎপাদনশীলতা বাড়ছে, তেমনি কমছে কর্মসংস্থান। শ্রমঘণ্টা নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবে শ্রমিকদের অধিক সময় কাজ করতে হয়। কিছু কারখানায় অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হলেও অধিকাংশ জায়গায় শ্রমের মূল্যায়ন যথাযথ হয় না।
পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত থাকলেও তা জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে অধিকাংশ শ্রমিকই বাজারের উর্ধ্বমুখী দামে অসহায় হয়ে পড়ছেন। অভিযোগ রয়েছে—কিছু কারখানায় এখনো শ্রম আইন মেনে মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় না।
পোশাক কারখানার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন কয়েকজন শ্রমিক।
সাভারের একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত সালমা বেগম বলেন, “আমার বড় বোন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে দেখতে যেতে পারিনি। অফিসে জরুরি শিপমেন্ট থাকায় ছুটি পাইনি। যখন হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়, তখন গিয়ে দেখি। গার্মেন্টসে যারা চাকরি করে, তাদের জীবনে পরিবার, পরিজন, সখ কিছুই থাকে না।”
হাবিব নামে আরেক শ্রমিক বলেন, “গত ৮ বছর ধরে কাজ করছি। মাস শেষে যা বেতন পাই, তা হাতে রাখার সুযোগই হয় না। দোকান বাকি, বাসা ভাড়া, ওষুধের খরচ, বাড়িতে মা-বাবার জন্য কিছু পাঠাতে হয়—সব শেষে নিজের জন্য কিছুই থাকে না।”
রেশমা আক্তার, এক নারী শ্রমিক বলেন, “স্বামীর সংসার ভেঙে যাওয়ার পর সমাজের নানা কথার মুখে ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে চাকরি নেই। কাজের চাপে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগও হয় না। সারা সপ্তাহ তো দূরের কথা, দুই ঈদ ছাড়া বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয় না।”
শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের অভাব, দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কাজ করা, ধুলাবালি ও সুতার কণার কারণে তাঁরা শ্বাসতন্ত্রের রোগ, চোখের সমস্যা ও নানান স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগেন।
সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়—কম মজুরি, অনিরাপদ পরিবেশ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও একাকীত্বের বোঝা নিয়ে পোশাক শ্রমিকরা এক কঠিন জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত।
পোশাক শিল্প দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হলেও এর মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজন মালিকপক্ষ, সরকার ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও মানবিক কর্মব্যবস্থাই হতে পারে পোশাক শ্রমিকদের জীবনের স্বস্তি ফেরানোর পথ।