মরুভূমির জাহাজ উট : চিকিৎসা ও মানবকল্যাণে বিস্ময়কর অবদান

স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক:

উট—যাকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ। কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা, দীর্ঘদিন পানি ছাড়াই চলতে পারা এবং ভার বহনে সক্ষমতা মানবসভ্যতার ইতিহাসে তাকে করেছে অনন্য। শুধু পরিবহন নয়, উটের দুধ, মাংস, চামড়া, পশম থেকে শুরু করে অশ্রু ও মূত্র পর্যন্ত মানুষের জীবনে রাখছে নানা অবদান। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন— “তারা কি উটের দিকে তাকায় না, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?” (সুরা গাশিয়া : আয়াত ১৭)।

শারীরিক গঠন ও খাদ্যাভ্যাস

উট দুই প্রকার—ড্রোমেডারি (এক কুঁজ) ও ব্যাকট্রিয়ান (দুই কুঁজ)। কুঁজে জমা থাকে চর্বি, যা খাদ্যের অভাবে শক্তি জোগায়। উটের পাকস্থলীর পাশে বিশেষ থলিতে পানি জমে থাকে, যা তাকে ৮–১০ দিন পর্যন্ত পানি ছাড়া টিকিয়ে রাখে। পায়ের তলায় নরম প্যাড বালিতে ডুবে যাওয়া রোধ করে।

উট প্রতিদিন ২০–২৫ মাইল পথ চলতে পারে কয়েক মণ বোঝা নিয়েও। এরা কাঁটাযুক্ত গাছ পর্যন্ত খেয়ে বাঁচতে পারে। এই বিশেষ খাদ্যাভ্যাসের ফলেই উটের দুধ ও মূত্রে জমা হয় বিরল চিকিৎসাগত উপাদান।

অটিজম ও ডায়াবেটিসে উটের দুধ

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, উটের দুধে রয়েছে ল্যাক্টোফেরিন, ইম্যুনোগ্লোবিউলিন ও ইনসুলিনজাতীয় প্রোটিন। তাই এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এছাড়া মানব দুগ্ধের মতো উটের দুধেও বেটা-ল্যাক্টোগ্লোবিউলিন নেই—ফলে অটিজম বা অ্যালার্জিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য এটি বিকল্প দুধ হিসেবে কার্যকর হতে পারে।

উটের অশ্রু : অ্যান্টিভেনমের সম্ভাবনা

ভারতের বিকানেরের ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অন ক্যামেলের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, উটের চোখের জলে পাওয়া অ্যান্টিবডি ২৬ প্রজাতির বিষাক্ত সাপের বিষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে। ভবিষ্যতে এটি অ্যান্টিভেনম তৈরিতে বিপ্লব আনতে পারে। বর্তমানে যে প্রতিষেধক তৈরি হয় তা মূলত ঘোড়ার ইম্যুনোগ্লোবিউলিন থেকে।

উটের মূত্রে চিকিৎসার সম্ভাবনা

সৌদি মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডা. আহলাম আওয়াদি ও সুদানের গেজিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, উটের মূত্রে উচ্চমাত্রায় প্রোটিন, পটাসিয়াম ও ইউরিয়া বিদ্যমান। এ থেকে তৈরি ওষুধ একজিমা, ব্রণ, হেপাটাইটিস, ক্যান্সার, হাঁপানি, স্ট্রোক, হজমজনিত ব্যাধি ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় কার্যকর হতে পারে।

অধ্যাপক আহমেদ আবদুল্লাহ আহমেদানির গবেষণায় দেখা গেছে, উটের মূত্র লিভারের টিউমার ও অ্যাসাইটিস চিকিৎসায় সফল প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামী বিজ্ঞানী ডা. জাঘলুল নাজ্জারও উল্লেখ করেন, বিশ্বের শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেরনো নবীজির (সা.)-এর হাদিস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীদের বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভধারণ চিকিৎসায় উট-ভিত্তিক ওষুধ তৈরি করেছে।

সর্বজনীন উপকারে মরুর প্রাণী

মানবসভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত উট কেবল মরুভূমির বাহনই নয়, বরং চিকিৎসা, খাদ্য ও জীববৈচিত্র্যের আশ্চর্য সম্পদ। আধুনিক বিজ্ঞান উটের দুধ, অশ্রু ও মূত্রের মধ্যে যে চিকিৎসা-সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছে, তা ভবিষ্যতে মানবকল্যাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *