মো. আতিকুর রহমান, ঢাকা: রাতের গভীরতম নিস্তব্ধতায়, ২২ সেপ্টেম্বর রাত ২টা ৪৪ মিনিটে নিভে গেল এক আলোকবর্তিকা। দীর্ঘদিন মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়াই শেষে আলীগাঁও এ. গফুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক জনাব জহিরুল ইসলাম চলে গেলেন না–ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ যেন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়—আর চারদিককে গ্রাস করল এক অদৃশ্য শূন্যতা।
জহিরুল ইসলাম ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যাদের উপস্থিতি চোখে না পড়লেও হৃদয়ের গভীরে অনুভূত হয়। তিনি ছিলেন শিক্ষক, কিন্তু কেবল পাঠ্যবইয়ের শিক্ষক নন। তিনি শেখাতেন সততা, সহমর্মিতা, জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধ। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে অদৃশ্য এক আলো জ্বালিয়ে দিত। কঠিন সমীকরণ কিংবা জটিল ব্যাকরণকে তিনি কেবল বোঝাতেন না—তিনি শিখিয়ে দিতেন ধৈর্য ধরতে, চিন্তা করতে, মানুষ হতে। নিজ কর্মস্থল প্রাঙ্গণে যখন শত শত মানুষ জড়ো হয়ে তাঁর জানাজায় অংশ নিল, সেখানে শুধু শোকের ভার ছিল না—ছিল এক অব্যক্ত কৃতজ্ঞতা। সহকর্মীদের চোখের জলে ধরা পড়ল সম্মান, পুরোনো শিক্ষার্থীদের দীর্ঘশ্বাসে ভেসে উঠল স্মৃতির নদী। সেই প্রাঙ্গণ, যেখানে তিনি অগণিত বার দাঁড়িয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে জ্ঞান দিয়েছিলেন, সেদিন নীরব হয়ে তাঁকে বিদায় জানাল।
জহিরুল ইসলামকে নিয়ে কথা বলতে গেলে কেবল একজন শিক্ষককে বর্ণনা করা যথেষ্ট নয়। তিনি ছিলেন এক মানবিক পাঠশালা, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী শিখেছে নীরবে ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, প্রকৃত শিক্ষকের পরিচয় কেবল জ্ঞানের বিস্তারে নয়, মানুষের মনের ভেতর আলো জ্বালানোর ক্ষমতায়।
তাঁর দেহ শায়িত পারিবারিক কবরস্থানে, কিন্তু তাঁর বপন করা জ্ঞানের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আরও বহু প্রজন্মে। তাঁর শেখানো সৎপথের শিক্ষা, মমতার দৃষ্টান্ত, আর নীরব সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়তো একদিন নতুন কোনো শিক্ষার্থীর হাতে আবারও আলো হয়ে ধরা দেবে।
মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু কিছু মানুষ সময়ের সীমা পেরিয়ে বেঁচে থাকেন তাঁদের কাজের মধ্যে, তাঁদের ছড়িয়ে দেওয়া ভালোবাসায়। জনাব জহিরুল ইসলাম সেই বিরলদের একজন—যিনি নিজ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে আলো হয়ে অন্যের জীবন ছুঁতে হয়।