ভোরের দূত। Bhorer Dut

স্বায়ত্তশাসন বনাম শিক্ষার মান: সাত কলেজে শিক্ষক মানববন্ধন ও শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ

সম্পাদকীয়

মো: আব্দুর রহমান প্রামাণিক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ—বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এই কলেজগুলো সাধারণ মানুষের শিক্ষা গ্রহণের দরজা হিসেবে কাজ করেছে। বহু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এই কলেজগুলোকে উচ্চশিক্ষার মান ও প্রথার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন।

২০১৭ সালে এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়। এটি ছিল উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনার একটি প্রয়াস। তবে সেই পরিবর্তন বাস্তবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আনতে পারেনি। প্রশাসনিক জটিলতা, শিক্ষকসংকট, একাডেমিক পূর্বাভাসের অভাব এবং পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘ বিলম্ব শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। এই সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে।

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সামনে মানববন্ধন করেন। তাদের মূল দাবিগুলো ছিল—বেতন স্কেল  উন্নয়ন, পদোন্নতি, গবেষণা ও একাডেমিক সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, দীর্ঘদিন ধরে তাদের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার মান ও পরিবেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। মানববন্ধনের মাধ্যমে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, যেন তাদের ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নেওয়া হয় এবং শিক্ষার মান রক্ষা পায়।

শিক্ষকদের মানববন্ধন শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তারা দেখেছেন, যদি কোনো কার্যকর সমাধান না আসে, তবে তাদের পড়াশোনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। তাই ১৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের শহীদ মিনার থেকে প্রতিবাদ সভা ও সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, শিক্ষকরা যে ন্যায্য দাবি তুলেছেন, তা সমর্থনযোগ্য। তবে এই আন্দোলনের ফলে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া এড়াতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।

সাত কলেজের বর্তমান সমস্যার মূল কারণ হলো প্রশাসনিক কাঠামোর অসঙ্গতি। অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য পরিষ্কার সময়সূচি না থাকা, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব, ক্লাস শিডিউল ও ভর্তি প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষকসংকট, অবকাঠামোর অভাব এবং শিক্ষকের যথাযথ বেতন-অনুপ্রেরণা না থাকা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন, এই অনিশ্চয়তা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ব্যাহত করছে।

কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের প্রস্তাব শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, একক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রশাসনিক জট কমবে, পরীক্ষা ও ফলাফল সময়মতো হবে এবং শিক্ষার মান উন্নত হবে। অন্যদিকে, শিক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, নতুন কাঠামো তাদের স্বায়ত্তশাসন হ্রাস করবে এবং পদ, বেতন ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে মহিলা কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের মানববন্ধন এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ—দুটি পার্শ্বই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তিসঙ্গত। শিক্ষকরা নিজেরা নিরাপদ ও স্বতন্ত্র অবস্থান রক্ষা করতে চাইছেন। শিক্ষার্থীরা চাইছেন যেন শিক্ষার মান ও সময়মতো ফলাফল নিশ্চিত হয়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে একটি সমন্বিত, অংশগ্রহণমূলক সমাধান অত্যন্ত জরুরি।

সম্ভাব্য সমাধানগুলো হলো—সাত কলেজকে একটি স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কলেজগুলোর অবকাঠামো—লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি ও প্রশাসনিক ভবন উন্নয়ন করা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, পরীক্ষার রুটিন ও ফলাফল প্রকাশ সময়মতো করা—এসব পদক্ষেপ শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করা হলে, সাত কলেজের সংকট সমাধান সম্ভব। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শুধু নাম পরিবর্তন বা কাঠামোর রূপান্তর যথেষ্ট নয়; শিক্ষার মান, সুযোগ-সুবিধা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অতি প্রয়োজন। শিক্ষা মান উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হলো প্রকৃত বিজয়, যা সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সারসংক্ষেপে, সাত কলেজের সংকট এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে উচ্চশিক্ষার মান রক্ষা করা মানে শুধু ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, দেশের মানবসম্পদ ও জাতীয় উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। শিক্ষকরা তাদের অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করতে মানববন্ধন করেছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিবাদ করেছেন। এই দ্বৈত প্রতিক্রিয়া—শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সমন্বয় ঘটালে, সাত কলেজের সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *