এস.এ.এম সুমন, ঢাকা: বাংলাদেশের নগর জীবনে যানজট এখন নিত্যদিনের অভিশাপে পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের প্রায় সব বড় শহরে ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। এই অচলাবস্থা শুধু নাগরিক ভোগান্তিই বাড়াচ্ছে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার ক্ষতি ডেকে আনছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার যানজটে প্রতিবছর প্রায় ৩৮ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানির অপচয়, অতিরিক্ত গাড়ির খরচ এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস এই ক্ষতিকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যানজটের প্রধান কারণসমূহ
১. অনুমোদনহীন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের আধিক্য।
২. অপ্রতুল ও অনিয়মিত গণপরিবহন ব্যবস্থা।
৩. ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির অভাব।
৪. হকার ও অবৈধ পার্কিংয়ের দখলদারিত্ব।
৫. সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজের দীর্ঘসূত্রিতা।
৬. রাস্তার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি।
৭. ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার আধিক্য: সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ যানবাহনগুলো সড়কে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে এবং প্রায়শই দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে।
যানজট নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞ ও নীতি-নির্ধারকদের মতে, যানজট সমস্যা নিরসনে কয়েকটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে-
১. ফিটনেসবিহীন ও অনুমোদনহীন যানবাহন বন্ধ: প্রতিদিন হাজার হাজার বাস, ট্রাক ও ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় চলাচল করছে যেগুলোর কোনো সঠিক ফিটনেস নেই। এ ধরনের যানবাহন বন্ধ করা গেলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে।
২. ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ: শহরে এ ধরনের যান চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। গ্রামীণ সড়কে বিকল্প ব্যবস্থা চালু করা এবং চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া অপরিহার্য।
৩. আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা: প্রযুক্তিনির্ভর ট্রাফিক সিগন্যাল ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করলে যানবাহনের চাপ অনুযায়ী সড়ক ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে।
৪. গণপরিবহন সংস্কার: একটি আধুনিক, দ্রুত, নিরাপদ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাস রুট রেশনালাইজেশন, মেট্রোরেল সম্প্রসারণ ও একক টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করলে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গাড়ির উপর নির্ভরশীলতা কমবে।
৫. অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও ফুটপাত মুক্তকরণ: হকার ও অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে সড়কের অর্ধেক জায়গা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে ফুটপাতকে পথচারীর জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।
৬. পার্কিং ব্যবস্থা উন্নয়ন: আধুনিক বহুতল পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রধান সড়কগুলোতে গাড়ি দাঁড় করানো বন্ধ হয়।
৭. সড়ক সংস্কার ও বিকল্প রাস্তা নির্মাণ: দ্রুতগতিতে সড়ক মেরামত এবং শহরে বিকল্প রোড নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। ফ্লাইওভার ও আন্ডারপাস আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে।
৮. আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা: ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তি কার্যকর করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে নিয়ম মানতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মিডিয়া, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. খন্দকার এনামুল হক বলেন “ঢাকার যানজট শুধু নাগরিক জীবনের ভোগান্তি নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক দুর্যোগ। আমরা যদি এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নেই, তবে আগামী ১০ বছরে নগরজীবন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে।”
যানজট শুধু সময় নষ্টের কারণ নয়; এটি মানুষের মানসিক চাপ বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। উন্নত নগরায়ণ ও স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে হলে এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও সচেতন হতে হবে। আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা, ফিটনেসবিহীন যান বন্ধ, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ এবং গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে একটি যানজট মুক্ত আধুনিক নগরী গড়ে তোলা সম্ভব।