আজ বিশ্ব বাঁশ দিবস: বাঁশ—অতীতের সংগ্রাম, বর্তমানের সম্পদ

সম্পাদকীয়

মো: আব্দুর রহমান প্রামাণিক: বাঁশের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা তুলে ধরার জন্য। বাঁশ কেবল একটি উদ্ভিদ নয়, এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা এক অমূল্য সম্পদ। আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পরিবেশ—সবকিছুর সঙ্গেই বাঁশের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, বাঁশ আসলে এক ধরনের বৃহৎ প্রজাতির ঘাস। এর কচি কোয়া বা বাঁশকোড়ল পাহাড়ি অঞ্চলে সুস্বাদু সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খাদ্যসংস্কৃতিতে বাঁশকোড়লের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। এতে ভিটামিন, ফাইবার ও মিনারেল সমৃদ্ধ পুষ্টিগুণ থাকায় এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অর্থাৎ বাঁশ শুধু নির্মাণ ও দৈনন্দিন কাজে নয়, খাদ্য হিসেবেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ভোরের দূত

বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঁশ শুধু গৃহস্থালির উপকরণ নয়, সংগ্রামের প্রতীকও বটে। ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহে তিতুমীর যে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন, তা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। বাঁশের তৈরি সেই দুর্গ ছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যা প্রমাণ করে বাঁশ কেবল দৈনন্দিন জীবনে নয়, প্রতিরোধ ও আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ভোরের দূত

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন বাঁশ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। ঘর তৈরির খুঁটি থেকে শুরু করে চাষাবাদের যন্ত্র, মাছ ধরার ফাঁদ কিংবা উৎসবের সাজসজ্জা—সবখানেই বাঁশের অবদান সুস্পষ্ট। আধুনিক যুগেও বাঁশ তার বহুমুখী ব্যবহারের কারণে নতুন করে মূল্যায়িত হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ফার্নিচার, কাগজ, কাপড় এমনকি বাঁশভিত্তিক শিল্পজাত পণ্য এখন বৈশ্বিক বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। অন্যদিকে, পরিবেশ রক্ষায় বাঁশের অবদান অনস্বীকার্য। দ্রুত বর্ধনশীল এই উদ্ভিদ স্বল্প সময়ে পরিপক্ক হয় এবং কার্বন শোষণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বন উজাড় ঠেকানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাঁশ হতে পারে কার্যকর বিকল্প।

ভোরের দূত

সম্প্রতি গবেষকরা বাঁশ নিয়ে নতুন এক সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করেছেন। জানা গেছে, বাঁশের ফুল থেকে চাল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে, যা বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জন্য বিকল্প খাদ্য উৎস হতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে বাঁশের ফুল অনেক সময় দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন তা থেকে মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের পথ খুলে যাচ্ছে। এ আবিষ্কার বাঁশের সম্ভাবনাকে আরও বহুমাত্রিকভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।

 

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে বাঁশের প্রতি সেই সচেতনতা ও পরিকল্পিত ব্যবহার তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। বাঁশের চাষ ও সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ সীমিত। স্থানীয় কারিগর ও শিল্পীদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বাঁশভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা গেলে তা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে এবং তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

ভোরের দূত

বিশ্ব বাঁশ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক বাঁশকে কেবল প্রাচীন গ্রামীণ উপকরণ হিসেবে নয়, বরং ভবিষ্যতের টেকসই উন্নয়ন, সবুজ অর্থনীতি এবং জাতীয় ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে দেখা। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা যেমন আমাদের শিখিয়েছে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, তেমনি আজকের বাঁশ আমাদের শেখাক প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই জীবন গড়ে তুলতে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *